হবিগঞ্জ : মনিপুরী বাংলাদেশে একটি পরিচিত নাম। মনিপুরী একটি জাতি সত্তার নাম। বাংলাদেশে মনিপুরীদের আগমন আড়াই শতাব্দী বছর পূর্বে । মনিপুরীরা স্বাধীনতা ও সৌন্দর্য্য প্রিয় জাতি। দেশের অন্যান্য জাতির মত তাদের রয়েছে এক সমৃদ্ধ ভাষা, সাহিত্য সংস্কৃতি। তাদের চলাফেরা, কথাবার্তা ও আচার আচরণ থেকেই এর প্রমাণ মেলে।
পরাধীনতার নাগপাশ থেকে দূরে সরে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মনিপুরী। বাংলাদেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মত রয়েছে অনেক মনিপুরী । এদের সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও এখন লাখের কাছাকাছি। নৃতাত্ত্বিক গবেষনায় মঙ্গোলীয় মহাজাতির তিব্বত ব্রম্ম পরিবারভুক্ত এই মনিপুরীরা তাদের আদি বাসস্থান মনিপুর রাজ্য ছেড়ে কখন কবে কিভাবে বাংলাদেশে আবাসস্থল গড়ে তুলল এ নিয়ে রয়েছে নানা কথা ।
বাংলাদেশে মনিপুরী জনগোষ্টির উৎপত্তিস্থল বা আবাসস্থল জানতে হলে ইতিহাসের দিকে তাকাতে হয়। কারণ বাংলাদেশে বসবাসরত অনেক মনিপুরীই তাদের উৎপত্তিস্থল কোথায়, কোথা থেকে তাদের আগমন সে সর্ম্পকে অনেকেরই অজানা। যারা জানেন তারাও আজ জীবন জীবিকার লড়াইয়ে মগ্ন। অপর দিকে সাম্প্রদায়িক রোষানলে পতিত হওয়ার আশংকা ছাড়াও বেশীর ভাগই অসচেতন। ফলে তাদের নিজস্ব জাতিস্বত্তা, সাহিত্য, সংস্কৃতি নিয়ে বা তাদের ভাষা নিয়ে এমন কি তাদের উপজাতি আখ্যায়িত করায় কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে দ্বিধাগ্রস্থ বা শংকিত।
মনিপুরীদের মূল উৎপত্তিস্থল ভারতের অন্যতম অঙ্গরাজ্য মনিপুর। বাংলাদেশে বসবাসকারী মনিপুরী সম্প্রদায়ের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা ও কৃষ্টি সমুদয় বিষয়ের সাথে মনিপুর রাজ্যের মনিপুরীদের সর্ম্পক মৌলিকভাবে একই সূত্রে গাঁথা। পার্থক্য শুধু রাজনৈতিক ও ভৌগলিক ক্ষেত্রে।
১৭৫৭ সালে ঐতিহাসিক পলাশী যুদ্ধেও কয়েক বছর পর ব্রিটিশ বেনিয়া শাসকগোষ্টির সাম্রাজ্য বিস্তারের অপকৌশল হিসেবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী গোষ্টি বাহ্যিক দৃষ্টিতে ব্যবসার নামাবলী গাঁয়ে এঁটে সর্বপ্রথম মনিপুরীদের সাথে সর্ম্পক স্থাপন করে। বৃহত্তর মঙ্গোলীয় জাতি গোষ্টির অন্যতম শাখা তিব্বত বার্মা বংশোদ্ভুত চিরকালের সহজ সরল শান্তিপ্রিয় প্রকৃতির অন্যতম গোষ্টি মনিপুরীদের সাথে এটাই ব্রিটিশদের প্রথম সম্পর্ক।
বিচিত্র প্রকৃতির বৈচিত্র্য মন্ডিত লীলা নিকেতন বলে খ্যাত মনিপুরের প্রাকৃতিক বনজ সম্পদেও যথাযথ মূল্য প্রদান ও উন্নয়নের কথা বলে তৎকালীন ব্রিটিশ বেনিয়া গোষ্টি মনিপুরের রাজতান্ত্রিক শাসক ও প্রজাদের সাথে ক্রমান্বয়ে ঘনিষ্ট সর্ম্পক স্থাপন করে। মনিপুরের তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা ব্রিটিশ মনিপুর সর্ম্পক স্থাপনের ক্ষেত্রে অনেকটা সহায়ক হয়েছিল। বার্মা কর্তৃক মনিপুর রাজ্য আক্রমনের সম্ভাবনা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে মনিপুরের সম্পর্ক স্থাপনের আরো একটি উল্লেখযোগ্য কারণ ।
১৭৬২ সালে ব্রিটিশ বেনিয়া কোম্পানী তাদের রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার মানসে মনিপুর রাজার সাথে সম্পাদিত এক চুক্তি অনুসারে ব্যবসাকে বিস্তৃত করার জন্য কিছু সংখ্যক মনিপরীকে আপন জন্মভুমি ত্যাগে উৎসাহিত করে তোলে। ফলশ্রুতিতে মনিপুরীরা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।
স্বাধীন চেতা মনিপুরী সম্প্রদায় : স্বাধীনচেতা মনিপুরীরা ইংরেজদের শাসন নিঃশব্দে মেনে নেয়নি। পরাধীনতার অসহ্য জ্বালায় তারা জ্বলেপুড়ে মরছিল। মনিপুরের রাজা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবাই বিক্ষুব্ধ ছিল। সেই বিক্ষোভ ধূমায়িত হয়ে উঠতে উঠতে একদিন তা প্রকাশ্য বিদ্রোহে ফেটে পড়ল। একদিকে ক্ষুদ্র মনিপুর অন্যদিকে প্রভাবশালী ব্রিটিশ সরকার। যুদ্ধক্ষেত্রে পরস্পরকে মোকাবেলা করল। আর পরিণামে যা ঘটার তাই ঘটল। এই উপমহাদেশের সেই ইতিহাস মনিপুরে তারই পুনরাবৃত্তি হলো ।
“ লাঠি যার মাটি তার ” এই নীতিকে অনুসরণ করে ইংরেজ সরকার মনিপুরের এই বিদ্রোহকে চুর্ণবিচুর্ণ করে দিল। মনিপুরীদের পক্ষে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন বীরেন্দ্র কেশরী টিকেন্দ্রজিত। তিনি রাজ পরিবারের ছেলে। যুদ্ধে বন্দী হলেন তিনি। স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার অপরাধে তাঁকে ফাঁসি কাষ্টে ঝুলতে হয়। যেদিন টিকেন্দ্রজিতের ফাঁসি, সেদিন এই উপমহাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত শোকের কালো ছায়া নেমে আসে। বিদ্রোহকে চুর্ণ করে দিয়ে আর বীর নায়ক টিকেন্দ্রজিতকে ফাঁসি কাষ্টে ঝুলিয়েও ইংরেজ সরকার নিশ্চিত হতে পারেনি। মনিপুরীদের দেশপ্রেম আর শৌর্যের পরিচয় পেয়ে তারা স্তম্ভিত হয়ে যায়।
ইংরেজরা ভবিষ্যত বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে দূর করার জন্য মনিপুরের রাজাকে সিলেট শহরে এনে অন্তরীণ করে রাখে। রাজাকে তাঁর স্বদেশ মনিপুর থেকে ছিনিয়ে এনে সুদূর সিলেট শহরের বুকে অন্তরীণ করার পর থেকে এক বিচিত্র ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। দলে দলে মনিপুরীরা স্বদেশের মায়া ছেড়ে রাজার পেছন পেছন চলে আসতে থাকে। কিন্তু তাদের শহরে থাকার অনুমতি দেয়া হয়নি। তাই তারা বনাঞ্চল আবাদ করে সেখানেই তাদের আবাসস্থল গড়ে তুলে। কালক্রমে এভাবেই বাংলাদেশে মনিপুরীদের বসতি স্থাপিত হয়।
সহজ সরল প্রকৃতির মনিপুরীরা বাংলাদেশের বিভিন্নস্থানে আবাসস্থল গড়ে তুলে। অনাবাদী জমিকে আবাদ করে ফলে ফসলে সমৃদ্ধ করে তোলে । দিনে দিনে তাদের জনসংখ্যাও বাড়তে থাকে। মনিপুরীরা সুখে শান্তিতে বসবাস শুরু করে, কিন্তু তাদের এ সুখ বেশী দিন টেকে না। পরিস্থিতি বদলে যায়। দেখা দেয় বিরোধ। বেঁধে ওঠে সংঘাত আর হানাহানি। তবে এবার ব্রিটিশ বেনিয়াদের সাথে নয়, প্রতিপক্ষ ব্রিটিশ বেনিয়াদের আর্শীবাদপুষ্ট জমিদার শ্রেণীর সাথে ।
বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারী মনিপুরীদের জমিদার শ্রেণী অমানষিক অত্যাচার উৎপীড়ন ও শোষণ চালায়। কিন্তু মনিপুরীরা জমিদারদের সেই অন্যায় মাথা পেতে নেয়নি। অন্যায়ের কাছে মাথা না করে তারা প্রতিবাদী হয়ে উঠে। জমিদাররা এক পর্যায়ে হাতি দিয়ে তাদের ঘরবাড়ী ভাংচুর শুরু করে। জমিদারদের এই অন্যায় প্রতিহত করতে দরিদ্র অসহায় মনিপুরীরা জীবনপণ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। হাতির আক্রমন প্রতিহত করতে মহিলারাও মাঠে নামে । থালা-বাসন, করতাল নিয়ে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। মনিপুরীরা এমনিতে সহজ সরল ও শান্ত প্রকৃতির, তবে ক্ষেপে গেলে আগুন।
বাংলাদেশে মনিপুরীদের আবাসস্থল : বাংলাদেশের সর্বত্র মনিপুরী সম্প্রদায়ের আবাসস্থল না থাকলেও রাজধানী ঢাকায় এখনো একটি এলাকা মনিপুরীপাড়া নামে পরিচিতি রয়েছে। ময়মনসিংহের দূর্গাপুর, সিলেট শহরের মনিপুরী রাজবাড়ীসহ শহরের কোন কোন পাড়া মহল্লা, মৌলভীবাজার জেলার শমসেরনগর, কমলগঞ্জ, ভানুগাছ, আদমপুর, হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার বিশগাও পরগনার কাঠুয়ামারা, আবাদগাও, শিবনগর, সুন্দরপুর ,ঘনশ্যামপুর, ছয়শ্রী গ্রামে বিপুল সংখ্যক মনিপুরী বাঙ্গালী জনসমুদ্রে এখনো মিশে আছে।
মনিপুরীরা আপোষহীন একটি জাতি : ব্রিটিশ ও পাকিস্তানী শাসনামলে মনিপুরী সম্প্রদায় বিভিন্নভাবে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হয়েছে। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানীদের নানামুখী অত্যাচার, নির্যাতনের মুখেও তারা প্রতিবাদ করে এ উপমহাদেশে ঠিকে আছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে মনিপুরী সম্প্রদায়ের ছাত্র, যুবক, কৃষকসহ বিভিন্ন পেশার মনিপুরীরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। বীর বিক্রমে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়। সম্মুখ সমরে লড়াই করে অনেকেই শহীদ হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে গুরুদায়িত্বশীল পদে অনেক মনিপুরী সম্প্রদায়ের লোক দেশ সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন। বাংগালীর ন্যায় সঙ্গত সকল অধিকার আদায়ের আন্দোলন সংগ্রামে মনিপুরীদের ভুমিকা ছিল গর্বের সম্মানের।
মনিপুরীরা জাতি না উপজাতি : পাহাড়ী উপজাতিদের সাথে চেহারাগত সাদৃশ্যের কারণে মনিপুরীদেরকে এক সময়ে মিলিটারী সরকার উপজাতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। কিন্তু মনিপুরীরা তা নিঃশব্দে মেনে নেয়নি। প্রতিবাদ করেছে। তারা নিজেদের উপজাতি হিসেবে অবমাননাকর মনে করে ক্ষুব্ধ হন। উপজাতি সমস্যার সূত্রপাত পাকিস্তান আমল থেকেই । তৎকালীন সরকার পত্রপত্রিকা ও বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে মনিপুরী সম্প্রদায়কে উপজাতি আখ্যায়িত করে। সেই ধারা সামরিক শাসক এরশাদ সরকার আমলেও পুনরাবৃত্তির চেষ্টা করা হয়। মনিপুরীদের দাবী হচ্ছে তারা উপজাতি নন। তাদের রয়েছে ঐতিহ্যমন্ডিত ভাষা, সাহিত্য সংস্কৃতি ও মূল উৎসস্থল। জাতিস্বত্তার দিক দিয়ে তারা একটি পূর্ণাঙ্গ জাতি। তারা উপজাতি নন।
প্রকৃত মনিপুরী কারা, কোন ধর্মাবলম্বী : বাংলাদেশে বসবাসরত মনিপুরী কারা ? সাধারণভাবে বলা যায়, ভারতের অঙ্গরাজ্য মনিপুরের মূল অধিবাসী যারা তারাই প্রকৃত মনিপুরী। যারা নিজেদের “মৈতৈ” নামে পরিচিত দিয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে মৈতৈ তথা মূলমনিপুরী ছাড়াও আরো তিনটি ক্ষুদ্র্র ক্ষুদ্র সম্প্রদায় রয়েছে। যেমন “বিষ্ণুপ্রিয়া, মৈতৈ প্রাঙ্গন বা মনিপুরী মুসলমান এবং কীর্তনীয়া বা কিতানা। যারা ইতিহাসের ধারায় মূল মনিপুরীদের সাথে মিশে গিয়েছিল। তারা বৃহত্তর অর্থে মনিপুরী পরিচয়ে পরিচিত। মনিপুরীরা সনাতন ধর্মাবলম্বী। তারা পূজা অর্চনা করে থাকে। মনিপুরী মহিলারা নৃত্যকে ধর্মপালনের মতই তারা মনে করেন।
ভাষা ও মনিপুরী লিপি : ভাষাতাত্তিক বিচারে মনিপুরীরা মঙ্গোলীয় মহাজাতির তিব্বত ব্রম্ম শাখার চীন গোষ্টির অর্ন্তভুক্ত। মনিপুরী ভাষা বলতে মৈতৈ লোনকেই বুঝানো হয়ে থাকে। যা মূল মনিপুরী ভাষা বলতে মৈতৈলোনকেই বুঝানো হয়। যা মৈতৈ ছাড়াও মনিপুরী মুসলমান এবং কীর্তনীয়া সম্প্রদায়ের মাতৃভাষা। অপর দিকে বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদায়ের উপভাষা মিশ্র বা অসমীয়। যা বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
মনিপুরীদের নিজস্ব লিপি রয়েছে। মনিপুরী রাজা পাখং বাংলা খ্রীষ্টিয় প্রথম শতকে প্রথম মনিপুরী লিপির উদ্ভাবন করেন। এই বর্ণমালার সংখ্যা ছিল ১৮টি। পরে সপ্তদশ শতাব্দীতে মহারাজ খাগেম্বা কর্তৃক আরো ১৪টি বর্ণমালা সংযোজিত হয়। অনেক ঐতিহাসিক মনিপুরী লিপি দেব নাগরির সাদৃশ্য আবিষ্কার করে দাবী করেন যে, মনিপুরী লিপি দেব নাগরী থেকে উদ্ভুত । আবার মতান্তরে মনিপুরী লিপি ব্রম্মীলিপি থেকে উদ্ভুত।
মনিপুরী লিপির বৈশিষ্ট হলো প্রতিটি বর্ণমালার নামকরণ দেহের এককটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গের নামানুসারে এবং এর গঠন ও সংশ্লিষ্ট ওই অঙ্গ প্রত্যঙ্গেও গঠন প্রকৃতির সাথে সামঞ্জ্যপূর্ণ। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায় বাংলা “ক” এর মনিপুরী প্রতিবর্ণের নাম “কোক”, যার বাংলা অর্থ মাথা। এমনি করে বাংলা “স” এর মনিপুরী বর্ণ হলো “সম” যার বাংলা অর্থ চুল। মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের নামানসারে মনিপুরী বর্ণমালার নামকরণ এক অপূর্ব নিদর্শন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজা গরীবে নেওয়াজের আমলে মনিপুরী লিপির স্থান গ্রহণ করে বাংলা বর্ণমালা। সেই থেকেই মনিপুরী ভাষা বাংলা বর্ণমালাতে লিখা হয়ে আসছে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট