শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪

হবিগঞ্জের গণহত্যা: একটি গ্রন্থ, একটি স্বাক্ষর

  • আখতার উজ্জামান সুমন :
image

হবিগঞ্জ : আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে হবিগঞ্জ জেলার গুরুত্ব ও ভূমিকা অনন্য। অনন্য এই অর্থে যে: ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে যখন সারাদেশের মানুষ আন্দোলনে উদ্বেল হয়ে পড়েছিল, তখন পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী এ দেশের মানুষকে দমিয়ে রাখার জন্য এক নীলনকশা তৈরি করে। ২৫ মার্চ রাতে তারা অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালির উপর। শুরু করে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামক এক গণহত্যার মিশন। এই মিশনের উদ্দেশ্য ছিল নির্বিচারে বাঙালি হত্যা করা। সে-রাতে বঙ্গবন্ধুকে তারা গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। তাঁকে হয়তো হত্যা করার উদ্দেশ্যেই নিয়ে গিয়েছিল। জেনারেল ইয়াহিয়ার পরিকল্পনাটা হয়তো এরূপ ছিল: প্রথমে নির্বিচারে বাঙালি হত্যা করে পুরো জাতিকে দমিয়ে ফেলবে। তারপর কোনো-না-কোনো উপায় বের করে বঙ্গবন্ধুকে হয় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করবে আর নয়তো আজীবনের জন্য জেলে বন্দি করে রাখবে। কিন্তু ইয়াহিয়ার পরিকল্পনাটা ভেস্তে গেল। ২৬ মার্চ থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে সারাদেশে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। বাঙালি ‘ফাইট-ব্যাক’ এর সিদ্ধান্ত নিল। এই ‘ফাইট-ব্যাক’ এর শুরুটা হয়েছিল বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া থেকে। মাত্র কয়েকদিনের মাথায় ৪ এপ্রিল তারিখে কয়েকজন বাঙালি উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা জেনারেল এম.এ.জি ওসমানীর নেতৃত্বে তেলিয়াপাড়ায় ২য় ইস্টবেঙ্গল সদরদপ্তরে সমবেত হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁরা ‘ফাইট-ব্যাক’ এর সিদ্ধান্ত নেয়। তখন তাঁরা তেলিয়াপাড়ায় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম অস্থায়ী হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেন। আর এ কারনে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম থেকেই পাকিস্তানি সেনাদের নজরে ছিল এই হবিগঞ্জ জেলা।
এপ্রিলের প্রথম দিকেই পাকবাহিনী হবিগঞ্জে প্রবেশ করেছিল। অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র। ঘরে ঘরে প্রবেশ করে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ থেকে শুরু করে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মত ঘটনা ঘটায় তারা। বিশেষ করে চা-বাগান, প্রত্যন্ত অঞ্চল ও হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় তারা এসব কাণ্ড বেশি বেশি ঘটায়। এসব ঘটনার কোনো সুনির্দিষ্ট বিবরণ এতদিন আমাদের হাতে ছিল না। থাকার কথাও নয়, কারণ কে রাখে কার খবর! কিন্তু অনুসন্ধানী সাংবাদিক মিলন রশীদকে আমি ধন্যবাদ দিতে চাই। তাঁর গ্রন্থ ‘হবিগঞ্জের গণহত্যা’ থেকে এসব লোমহর্ষক ঘটনা সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছে আমাদের। এই গ্রন্থে ওঠে এসেছে মর্মন্তদ সব লোমহর্ষক ঘটনাবলির বর্ণনা। পাশাপাশি তিনি হবিগঞ্জে সংঘটিত কিছু যুদ্ধের বর্ণনাও করেছেন গ্রন্থে।
লেখক জেলার বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্র ও অসংখ্য নর-নারী, শিশু-কিশোর, যুবক-বৃদ্ধসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষের হত্যাযজ্ঞ নিখুঁতভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সরেজমিনে গিয়ে শহিদ পরিবারের দুঃখগাঁথা ও জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের স্মৃতিসৌধ নির্মাণের অজানা কাহিনী তুলে ধরেছেন। একটা বিষয় গ্রন্থটিকে আরো প্রাণবন্ত করেছে। স্পটে স্থানীয়দের সাথে লেখকের ছবি ছাপা হয়েছে। গ্রন্থটি পড়ে মনে হয় লেখক সরেজমিন অনুসন্ধানে গুরুত্বারোপ করেছেন বেশি। প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখের ভাষা সরাসরি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তিনি।
প্রায় ৫১ বছর পূর্বের সেই দুঃসহ সময়ের দুঃখ-বেদনার স্মৃতি ছড়িয়ে রয়েছে গ্রন্থের প্রতিটি পাতায় পাতায়। গ্রন্থটির প্রচ্ছদে আঁকা সাদা জমিনের উপর রক্তাক্ত স্মৃতিসৌধ যে-কাউকেই মনে করিয়ে দিতে পারে সেই যুদ্ধদিনের দুঃখগাঁথার অবর্ণনীয় স্মৃতির কথা। যুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মের জন্য গ্রন্থটি একটি অমূল্য দলিল হিসেবে পরিগণিত হবে বলে আমি মনে করি।
যাঁরা এই গ্রন্থ রচনায় লেখকের পাশে ছিলেন, তাঁদের কথাও লেখকের ভাষায় ওঠে এসেছে। গ্রন্থটি পাঠকের কাছে সমাদৃত হোক, এবং বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের মানসপটে মুক্তিযুদ্ধের অজানা ও অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগের বর্ণনা প্রতিফলিত হোক। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অক্ষয় এক স্বাক্ষর হয়ে থাকুক ‘হবিগঞ্জের গণহত্যা’ গ্রন্থটি।

আখতার উজ্জামান সুমন, ইতিহাস গবেষক ও লেখক

 

 

 


এ জাতীয় আরো খবর