শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

জাতীয় দলে ডাক পেলেন হবিগঞ্জের অনিক

  • শাহ ফখরুজ্জামান :
image

হবিগঞ্জ, ২২ মার্চ : নড়াইল এবং হবিগঞ্জ একই মানদন্ডের জেলা। তবে প্রশাসনিক ক্যাটাগরিতে হবিগঞ্জ জেলার মানদন্ড “এ” ক্যাটাগরিতে। নড়াইলের পরিচিতি ছিল টেবিল টেনিস খেলার জেলা হিসাবে। তবে দ্রুত এই পরিচয় বদলে দিয়ে ওই জেলার পরিচিতি ঘটে মাশরাফির জেলা হিসাবে। ক্রীড়া ঐতিহ্য বা তারকা ক্রীড়াবিদের মাধ্যমে যে কোন অঞ্চল বা জনপদ এমনকি দেশের পরিচিতি বৃদ্ধি পায় এটি সর্বজনবিদিত। হবিগঞ্জ জেলাও একটি খেলাধুলার ঐতিহ্যবাহী জনপদ। শত বছরে অনেক ক্রীড়াবিদের জন্ম হয়েছে এই মাটিতে। ফুটবলে এই জেলার পরিচিতি একসময় সমগ্র উপমহাদেশে প্রসিদ্ধ ছিল। তবে ক্রিকেটেও আমাদের ঐতিহ্য অনেক সমৃদ্ধ। টেস্ট ক্রিকেটার নাজমুল হোসেন জাতীয় দলে খেলেছেন এক দশক। এশিয়া কাপে স্বর্ণপদকসহ দলের অনেক অর্জনে তার নাম জড়িয়ে আছে। এবার হবিগঞ্জবাসীকে নতুন আনন্দ এনে দিয়েছে জাকের আলী অনিক। আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি সিরিজের জন্য সে ডাক পেয়েছে জাতীয় দলে। এই অর্জনে আমরা আনন্দিত ও গর্বিত।
জাকের আলী অনিক হবিগঞ্জের মাটিফোটা ক্রিকেটার। ১৬ বছরপূর্বে আমি তখন ছিলাম হবিগঞ্জ অনুর্ধ ১৪ ক্রিকেট দলের দায়িত্বে। ১২ বছরের ছোট্ট অনিক সে সময় ৫ম শ্রেণীতে পড়লেও দলে উইকেট রক্ষক ও ব্যাটসম্যান হিসাবে সুযোগ পায়। ছোট্ট শারিরিক গড়ন এবং বয়স কম হলেও সাহস এবং আগ্রহের কারণে সে সুযোগ পেয়ে যায় দলে। একাদশেও ছিল নিয়মিত। পর পর তিন বছর সে অনুর্ধ-১৪ দলে সুযোগ পায়। একটি বছর তার ছন্দপতনও হয়েছিল। কারণ দলে আসা আরেক উইকেট রক্ষক ব্যাটসম্যান আশিকের নৈপুণ্য ছিল তার ছেয়ে ভাল। সেবার দলের একাদশ থেকে তার বাদ পড়ায় মন খারাপ হয়েছিল তার। কিন্তু যার ইচ্ছা পেশাদার ক্রিকেটার হবে সে এই বঞ্চিত হওয়াকে জেদ হিসাবে নিয়ে কঠোর অনুশীলন এবং নিবেদনের মাধ্যমে পরে ঠিকই তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছে যায়। বিকেএসপির ট্যালেন্টহান্ট প্রোগ্রামে সুযোগ পায় সেখানে ভর্তির সুযোগ। আর এতেই সে পেয়ে যায় স্বপ্নপুরণের ১ম সিড়ি। পরে সে সেই সিড়ির একটি একটি করে ধাপ অতিক্রম করে আজ জাতীয় দলে। তার এই জাতীয় দলে আশাটা প্রত্যাশিতই ছিল। তবে টি- টুয়েন্টি দলে আসবে সেটি এই মুহুর্তে কারও প্রত্যাশায় ছিল না। প্রত্যাশা ছিল সে টেস্টদলে সুযোগ পেতে পারে। কারন কিছুদিন পূর্বে শেষ হওয়া ঘরোয়া প্রথম শ্রেণীর টুর্ণামেন্ট বিসিএলএ পরপর তিনটি সেঞ্চুরী করে তার সম্ভাবনার বার্তা পৌছে দেয়। সেই টুর্ণামেন্টের সেরা খেলোয়াড়, সর্বোচ্চ রান ও সর্বোচ্চ ডিসমিসালের পুরস্কারও সে লাভ করে।
টি টুয়েন্টিতে বিপিএলএ তার নৈপুণ্য ছিল আশাজাগানিয়া। চলমান ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লীগেও আবাহনীর পক্ষে তার নৈপুণ্য ছিল কার্যকর। এর পুরস্কার হিসাবেই হয়ত সে সুযোগ পেয়েছে জাতীয় দলে। এই সুযোগ যদি সে কাজে লাগাতে পারে তাহলে হয়ত এক সময় টেস্ট ও ওয়ানডে দলেও সুযোগ এনে দিবে তাকে। খেলাটির প্রতি তার যে অনুরাগ আমি নিশ্চিত সে এই সুযোগটির কোন অপব্যবহার করবে না। জাকের আলী অনিক দুই বছর পূর্বে তার কিপিং দক্ষতার প্রমাণ দেয় বিপিএল এর একটি খেলায়। বদলী ফিল্ডার হিসাবে মাঠে নেমে ৬টি ডিসমিসাল করে বিশ্ব রেকর্ড করে। এতে করে বিশ্বরেকর্ডে নাম লেখানো হাতে গোনা কয়েকজন খেলোয়াড়ের মাঝে নাম চলে আসে অনিকের। বাংলাদেশ অনুর্ধ-১৯ ক্রিকেটে একটি মাত্র শিরোপা অর্জন করেছিল। সেই দলেও ছিলেন আমাদের অনিক। অনুর্ধ ১৫ ও অনুর্ধ ১৭ জাতীয় দলেও খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে অনিকের। হবিগঞ্জের ১ম ও এখনপর্যন্ত একমাত্র টেস্ট খেলোয়াড় নাজমুল হোসেন।
তবে বাংলাদেশে ক্রিকেটের আধুনিকায়ন শুরুর দিকেই হবিগঞ্জের আরেক কৃতি সন্তান কানাডা প্রবাসী খন্দকার নেহাল হাসনাইন জাতীয় পর্যায়ে প্রথম হবিগঞ্জের নাম লেখান। পরে হবিগঞ্জের মাটি থেকেই বেড়ে ওঠা সিরাজুল্লাহ খাদেম নিপু অনুর্ধ-১৯ দলের পক্ষে বিশ্বকাপে অংশ নেয়। ১ম শ্রেণীর ক্রিকেটে দুর্দান্ত শুরুর পর যখন সে জাতীয় দলের কাছাকাছি ছিল সেই সময়ে একটি দুর্ঘটনায় তাকে সড়িয়ে দেয় ক্রিকেট থেকেই। যদিও সে বর্তমানে পর্তুগাল জাতীয় দলের পক্ষে নিয়মিত ক্রিকেট খেলছে। হবিগঞ্জের শিপন নামে একজন খেলোয়াড় ফিনল্যান্ড জাতীয় দলে রয়েছে। এই জেলা থেকে জাতীয় দলে খেলার মত প্রতিভা নিয়ে হারিয়ে গেছেন মুন্না, রতন, তুর্জ, রুপু ও সাজনরা। যেহেতু অনুর্ধ-১৪ দল ব্যবস্থাপনা সহ সংগঠক হিসাবে দীর্ঘদিন মাঠে আছি সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি এই প্রতিভাগুলো ছিল অনন্য। শুধুমাত্র হবিগঞ্জে পেশাদার কাঠামো না থাকায় এখান থেকে অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ হারিয়ে যাচ্ছে বিকশিত হওয়ার পূর্বেই। যে রতনের কাছে পাত্তাই পেত না মৌলভীবাজারের রাজু। সেই রাজুও খেলেছে জাতীয় দলে। লিটন দাসের ছেয়েও ভাল খেলা রুপু জাতীয় দল পর্যন্ত যেতে না পারাটার দায় রুপুর। রতনের দায়ও রতনের। 
এক সময় সিলেট বিভাগের মাঝে বিভাগীয় শহর সিলেটের পরই হবিগঞ্জের অবস্থান ছিল সুসংহত। কিন্তু এখন আমাদের ছেয়ে মৌলভীবাজার এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। তাদের জাতীয় দলের তারকা এবাদতসহ বেশ কয়েকজন ১ম শ্রেণীর ক্রিকেটার রয়েছে। আমাদের অনিক ছাড়া আর একজনও ১ম শ্রেণীর ক্রিকেটার নেই। অথচ সিলেট বিভাগীয় দলের কোচ আমাদের সন্তান নাজমুল। হবিগঞ্জবাসীর বহু প্রত্যাশিত আধুনিক স্টেডিয়ার পেয়েছি আমাদের সংসদ সদস্য এডভোকেট মো. আবু জাহিরের প্রচেষ্টায়। তিনি ক্রীড়ানুরাগী ও ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বলেই আমাদের ক্রীড়াঙ্গন এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের এখানে পেশাদার কাঠামো নেই। পেশাদার কাঠামোর জন্য প্রয়োজন ইনডোর স্টেডিয়াম, জিমনেশিয়াম ও সুইমিংপুল। জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান উদ্যোগ নিয়ে একটি সুইমিংপুল বাস্তবায়ন করলেও তা পেশাদার ক্রীড়া অবকাঠামো গড়ার জন্য যথেষ্ট নয়। এ ব্যাপারে আমাদের উদ্যোগ নেয়া জরুরী।
অনিক জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ায় হবিগঞ্জের ক্রীড়াঙ্গনে আনন্দের জোয়ার বইছে। জেলা ক্রীড়া সংস্থার কেক কাটা হয়েছে। ফেইসবুকে বইছে অভিনন্দনের জোয়ার। এই সুযোগ আমাদের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করলেও আমাদের রয়েছে অনেক সীমাবন্ধতা। সেগুলোর সমাধান করতে পারলে আমরা আরও নাজমুল ও অনিক জাতীয় দলে উপহার দিতে পারব।
লেখকঃ আইনজীবী ও সাংবাদিক
সহ-সভাপতি
হবিগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থা


এ জাতীয় আরো খবর