শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪

চায়ের ইতিবৃত্ত

  • মিলন রশীদ :
image

হবিগঞ্জ, ২৯ জুলাই : এক সময়ে বিশ্ব জুড়ে জনপ্রিয় পানীয় ছিল কফি। জনপ্রিয় এ পানীয়কে ঠেলে কিভাবে চা জনপ্রিয় হয়ে উঠল ? এর পেছনে ছিল বৃটিশী কৌশল। চায়ের নেশা মানুষের মাঝে প্রবেশ করানো। চায়ের বিক্রি বাড়ানোর জন্য বৃটিশরা বিনা পয়সায় চা খাওয়াতো। নদী পারাপার থেকে লঞ্চ, ষ্টিমার, নৌকা, ট্রেনে চড়লে বিনা পয়সায় চা দিতো। মহিলারাও চা পান করতো। ফলে ধীরে ধীরে কফির স্থান দখল করে নেয় চা। কফির জনপ্রিয়তা তখনই কমতে শুরু করে। আর চা লাভ করে জনপ্রিয়তা। 

চায়ের বাজার ধরতে বৃটিশদের বিজ্ঞাপনী কৌশল : বৃটিশরা বিনাপয়সায় চা পান করিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি। তারা আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন প্রচার করতে লাগল। শীতে চা পান উপাদেয় হলেও গরমকালে যাতে বিক্রি অব্যাহত থাকে তার জন্য ব্যাপক প্রচারে বিজ্ঞাপনে বলা  হতো  “গরমে গরম ক্ষয় হবে ”। গ্রীষ্মকালে একমাত্র শীতল পানীয় চা, বিজ্ঞাপনে আরো ছিল প্রাণ শক্তি ও উৎসাহের উৎস এবং  ম্যালেরিয়া নাশক চা। সারাদিনের কঠিন শারিরিক পরিশ্রম বা মাথার কাজের পর এক কাপ ভালোভাবে তৈরী চা পান করলেই শরীর সজিব ও মন প্রসন্ন  হয়ে উঠবে। সত্যিই  চা জাগ্রত জীবনী শক্তির ভান্ডার। সকাল বেলা  নিয়ম করে অন্তত  দুই কাপ ভালো দেশী চা রোজ পান  করুন, জড়তা দূর হয়ে যাবে। সমস্ত দিন শরীর  মজবুত থাকবে। আবার  দিনের  শেষে দুই কাপ চা পান করুন। সারাদিনের খাটুনির পর মধুর ব্যাঘাত ঘটবেনা। এ সমস্ত বিজ্ঞাপন প্রচার করা হতো। এখন আর চা পানের বিজ্ঞাপনের প্রয়োজন  হয়না।
চীন জাপানের পরীক্ষাগারে  চায়ের গুণ  নির্গুণ : চায়না ও জাপানের পরীক্ষাগারে চায়ের কিছু গুণাগুণ আবিস্কৃত  হয়েছে। গ্রীন টি থেকে প্রস্তুত ট্যাবলেট ব্লাড প্রেসারের ওষুধ হিসাবে বহুল ব্যবহৃত হয় জাপানে। চায়নায় গ্রীন টি ব্যবহৃত হয় টুথপেষ্টের উপকরণে। চাতে ক্যান্সার নিরোধক গুণের  ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। তবে সাধারণ মানুষ দোষগুণের বিচার না করেই চা পান করে।
চায়ে  রয়েছে তিন ধরণের উদ্দিপক রাসায়নিক পদার্থ। সেগুলো হলো ক্যাফেইন, থিওবোমিন ও থিওপাইলিন। এ সমস্ত রাসায়নিক  পদার্থের  মাধ্যমেই  চা বিভিন্ন প্রকার রোগ দমনে এবং নিরাময়ে  সাহায্য  করে। সর্দি এবং হাপানি  চায়ের উদ্দিপক রাসায়নিক পদার্থ  ফুসফুসের সংকোচন রোধ করে এবং ফুসফুস প্রসারণে সহায়তা  করে। এতে শ্বাস প্রশ্বাস সহজ  হয় যা  হাপানি রোগীদের  জন্য  আরামদায়ক। সর্দি কাশির ক্ষেত্রে শ্বাসনালী থেকে মিউকাস নামের পদার্থ দূরিভূত করার মাধ্যমে চা এ সকল রোগের উপশম করে  থাকে। চায়ে  রয়েছে যথেস্ট পরিমাণে ফ্লোরাইড। যা দাঁতের ক্ষয়রোধে কার্যকরী। উদ্দীপক  রাসায়নিক পদার্থ ছাড়াও  চায়ে রয়েছে ট্যানিন। ট্যানিন মুখগব্বরে  অবস্থিত দাতের ক্ষয়ের  জন্য দায়ী ব্যাকটিয়াগুলোকে মেরে  ফেলে। ফলে ক্ষয়রোগ থেকে দাঁত রক্ষা পায়। ট্যানিন অন্ত্র ও পাকস্থলিতে কার্যকর ভূমিকা পালন  করে।  ফলে  ডায়রিয়া দমন  সহজ  হয়। অধিক মাত্রায় এক্সরে এবং অন্যান্য তেজস্ক্রিয় রশ্মির  প্রভাবে  শরীরের কোষের যে ক্ষতি সাধিত হয় সে ক্ষতি পূরণে চা সহায়তা  করে। চায়ের ট্যানিন নামের  রাসায়নিক পদার্থের কেটেচিন  নামের উপাদানটির মাধ্যমে  শরীরের কোষের  তেজস্ক্রিয়তা জনিত  ক্ষতি দমনে চা কাজ করে। ষ্টনসিয়াম ৯০  নামের তেজস্ক্রিয় রশ্মিকে শরীরের অস্থিমজ্জায় প্রবেশে বাধা দিতে সাহায্য করে । যারা তেজস্ক্রিয়তায়  আক্রান্ত তাদের ক্যান্সার প্রতিরোধে চা সহায়ক ভূমিকা পালন করে। চায়ের সর্বনাশা চরিত্র চিহ্নিত করেন বিভিন্ন চিকিৎসক। চিকিৎসকদের মতে, অতিমাত্রায় চা পান বদহজম, হৃদস্পন্দন, শিরঘূর্ণন, অনিদ্রা প্রভৃতি নানান রকম উপদ্রবের সৃষ্টি করে। এছাড়া স্নায়ুবিকারের যতগুলো কারণ  বিদ্যমান আছে এর মধ্যে ক্যাফিন নামের মাদকদ্রব্যের নিয়মিত ব্যবহার অন্যতম। চা ও কফিতে ক্যাফিন  রয়েছে। বেশী চা পান করলে  অম্ল, পেট কামরানি, কোষ্টকাঠিন্য, অনিদ্রা,  ক্ষিধে মন্দা ও হৃদযন্ত্রের নানা রকম বৈকল্য ঘটে। ফলে চা একবারে নির্গুণও নয়। 
সামাজিক  অনুষ্টানে সম্মানের চিহ্ন হিসেবে  চা : ১৬৬২ সালে এক সামাজিক অনুষ্টানে সম্মানের চিহ্ন হিসাবে চা পান করা হয়েছিল। চা আনা হয়েছিল বিদেশ থেকে। ১৭৭৪  সালে ওয়ারেন হেষ্টিংস ভারতে চা উৎপাদনের জন্য তিনিই প্রথম উদ্যোগী হয়ে উঠেন। এর  আগে কেউ ই চা চাষের  কথা ভাবেননি। ১৭৮৮  সালে স্যার জোসেফ ব্যাংকস বোটানিক্যাল গার্ডেনে কিছু চা গাছ লাগিয়ে সেখানে চা  চাষের সম্ভাবনা আছে কিনা দেখেছিলেন। তিনি সরকারকে জানিয়েছিলেন হিমালয়ের পাদদেশে রয়েছে চা চাষের উপযোগী মাটি ও  আবহাওয়া। ১৮৮৭ সালে কলকাতা বন্দরে আমেরিকান জাহাজ নোঙ্গর করে। চায়না হয়ে জাহাজটি আসায় অনেক কিছুর সাথে চা  পাতাও আনা হয়েছিল। যেহেতু চায়নায় চায়ের প্রচলন ছিল সেহেতু ওয়ারেন হেষ্টিংস চা চাষের জন্য চায়না থেকে বীজও এনেছিলেন ।  চায়নিজরা সব সিদ্ধ বীজ হেষ্টিংসকে দিয়েছিল। ফলে এতে আর গাছ হলোনা। চায়ের ব্যাপারে চায়নিজদের খুব উন্মাসিকতা ছিল। তারা  মনে করতো বুদ্ধদেবের চোখের পাতা থেকে  চা গাছের  জন্ম। এ কারণে চায়ের সাথে ঘুম না হওয়ার প্রসঙ্গটা জড়িয়ে  আছে।
চায়নিজদের কাছে চা নেশা দ্রব্য : চায়নায় ভেষজ চিকিৎসা ক্ষেত্রে চা ব্যবহার হয়ে  আসছে প্রায় তিন হাজার বছর আগে থেকে। কিন্তু  চা নামটা কিভাবে এলো আর কিভাবে বিস্তৃতি এ নিয়ে রয়েছে নানান কথা। চায়ের ভালো কোন না নেই। একমাত্র শব্দ চা। বৃটিশরা  বলে টি আর চায়নিজরা বলে “ বহিরা ”। ভারত বর্ষে চা  আসার আগে চায়নায় প্রচলিত ছিল। এ উপমহাদেশে চায়নায় প্রথম চায়ের  প্রচলন  হয়। চায়নায় জনপ্রিয়তা পাওয়ার পেছনে কারণ ছিল, সেকালে তাদের নেশা করার মানসিকতা। চায়নিজরা নানা রকম নেশাদ্রব্য গ্রহণ করতো। সে থেকে চাকে তারা সহজভাবে নেশা হিসেবে গ্রহণ করে। তবে সম্ভ্রান্ত লোকদের মধ্যে চা ছিল সীমাবদ্ধ। এ নিয়ে চায়নাদের কাছে চা  নিয়ে ছিল উপকথা ।
উপকথা : এক ভারতীয় নরপতি বৌদ্ধ ভিক্ষু ধর্ম প্রচারের জন্য পদব্রজে ভারত থেকে চায়না যাচ্ছিলেন। মাঝ রাস্তায় ঘুমিয়ে পড়েন  তিনি। ঘুম থেকে উঠে চোখ রগড়ে ভাবলেন ছিঃ ছিঃ, চোখের পাতা দুটোই তার চোখকে ঢেকে দিয়েছিল। যেই না ভাবা অমনি চোখের  দুটো পাতা কুচুৎ করে কেটে ফেলে দিলেন। ভগবান বুদ্ধের বরে পাতা দুটো হয়ে গেলো গাছের পাতা। আর সেই গাছটিই হল চা গাছ। সেই থেকে বৌদ্ধদের মধ্যে ক্লান্তিনাশক হিসাবে চায়ের প্রচলন শুরু হয়েছে।
আসামে  চা : ১৮২৩ সালে মেজর  রর্বাট ব্রুস আসামে দেখেন চায়ের গাছ আছে । তিনি তা সমতলে নিয়ে আসেন নমুনা হিসেবে ।  তার চা গাছ দেখেই বৃটিশ সরকার চা চাষে উদ্যোগী  হয়। তখন লর্ড বেন্টিংয়ের শাসনামল শুরু  হয়।
১৮৩৪ সালে ভারতে চা উৎপাদনের ব্যাপারে একটি “টি’ কমিটি গঠিত হয়। এতে দুজন ভারতীয় সদস্য ছিলেন। রাজা রাধাকান্ত দেব  ও রামকমল সেন। তাদের রাখার কারণ ছিল ব্যবসায়িকভাবে সাহায্য এবং দেশবাসীর সমর্থন পাওয়া ।
অবশেষে আসামে চা চাষ শুরু হয়। আসামের শেষ রাজা যিনি রবার্ট ব্রুস হাতে চা গাছ নমুনা স্বরূপ তুলে দিয়েছিলেন। আর  তখনই  দেওয়ান মনি রাম দত্ত বড়ুয়া তার নিজের বাগানে চা চাষ শুরু করেন। তিনিই প্রথম ভারতে চা গাছ লাগিয়ে ছিলেন।
পৃথিবীর প্রথম চা কোম্পানী  আসামে : ১৮৩৮ সালে প্রথম চা রপ্তানি করে ভারত। ইংরেজরা বাইরে থেকে চা এনে এখানে চাষ করে  বৃটেনে নিয়ে যাওয়া শুরু করে। সে কাজ সঠিক পদ্ধতিতে সমাধা করার লক্ষে পৃথিবীর প্রথম চা কোম্পানি “দি আসাম কোম্পানি” ১৮৩৯  সালের ১২ ফ্রেব্রুয়ারী গঠিত হয়। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ও মতিলাল শীল ছিলেন কোম্পানির দুই ডিরেক্টর। প্রথম  চা  কোম্পানির ডিরেক্টর দ্বারকানাথের  উদ্যোগেই জন্ম নেয় “বেঙ্গল টি এসোসিয়েসন।” চায়ের প্রথম  নিলাম হয় ১৮৬১ সালের  ২৭  ডিসেম্বর। ১৮৮৬ সালে গড়ে উঠেছিল ৪১ সদস্যের চা ব্যবসায়ী সংঘ ক্যালকাটা  টি ট্রের্ডাস এসোসিয়েশন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিষ্ট


এ জাতীয় আরো খবর