শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

বহু প্রতীক্ষীত সেমিকন্ডাক্টর ফিল্ডে ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে ভারত

  • সুপ্রভাত মিশিগান ডেস্ক :
image

নয়াদিল্লি, ২৭ ডিসেম্বর : চীনকে এবার প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও টেক্কা দিতে চলেছে ভারত। দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার পর অবশেষে কেন্দ্রীয় সরকার বহু প্রতীক্ষীত সেমিকন্ডাক্টর ফিল্ডে ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে। কেন্দ্রের এই পদক্ষেপের ফলে ভবিষ্যতে ভারত গোটা বিশ্বে টেকনো জায়েন্ট হিসাবে প্রতিপন্ন হবে।স্বাভাবিক ভাবেই এবার আমার আপনার মধ্যে প্রশ্ন উঠতে পারে, সেমিকন্ডাক্টর কী? এটা খায় না মাথায় দেয়? আর এর এমন কী চাহিদা রয়েছে যে এর পিছনে এত টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে? আসুন জেনে নেওয়া যাক বিস্তারিত। আমরা এমন একটা দুনিয়ায় বাস করছি যেখানে ঘুম থেকে ওঠা শুরু করে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত ইলেকট্রনিক্স গ্যাজেটের ব্যবহার করতেই হচ্ছে। আর সেটার অভাব দেখা দিলে জীবনটাই যেন ষোলো আনা ফাঁকি। ইলেকট্রনিক্স গ্যাজেট ছাড়া আমাদের চলবেই না। বর্তমান যুগ হল নানা ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী জুড়ে। যার অন্যতম হল, কম্পিউটার ও আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স। আর এই সব বস্তুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্ট হচ্ছে সেমিকন্ডাক্টর চিপসেট। মোবাইল, ল্যাপটপ, টিভি, ক্যামেরা, রেল ইঞ্জিন, বিমান, গাড়ি এমনকি এখন স্মার্ট ফ্যান, লাইটেও ব্যবহার করা হয় সেমিকন্ডাক্টর।
ভারত এখন ইলেকট্রনিক্স গ্যাজেটের সবচেয়ে বড় বাজার। ২০১৪-২০২০ সালের মধ্যে ভারতে ৭৫ বিলিয়ন ডলারের ইলেকট্রনিক্স দ্রব্য তৈরি হয়েছে। ডেটা অনুযায়ী আগামী ৬ বছরে এই চাহিদা দাঁড়াবে ৩০০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রায় ২০ লক্ষ কোটি টাকা। এটা তো শুধুমাত্রে ভারতে তৈরি পণ্যের হিসাব। এর বাইরেও বিদেশ থেকে আসছে প্রচুর গ্যাজেটস। এদিকে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার চাইছে ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ তৈরি করতে। আর সে জন্য দরকার প্রচুর ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী। এক্ষেত্রে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হল সেমিকন্ডাক্টর। ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়ার ক্ষেত্রে তাই এই ফিল্ডে ইনভেস্ট অত্যন্ত জরুরী। বর্তমানে একটি ভাল গাড়ি অর্ডার দেওয়ার পর তা ম্যানুফাকচারিং হতে সময় লেগে যায় প্রায় ছ’মাস। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, সেমিকনডাক্টরের অপ্রতুলতা। এই চিপসেট গাড়ির দরজা হ্যান্ডেলিং থেকে শুরু করে মিউজিক সিস্টেম সবেতেই প্রয়োজন। করোনা কালে লকডাউন ও মহামারির জেরে সেমিকন্ডাক্টর চিপসেট উৎপাদন ব্যাপক ভাবে ব্যাহত হয়েছে। শুধুমাত্র এই চিপসেটের অভাবে বিশ্বজুড়ে কেবল অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রিতে ক্ষতি হয়েছে ২১০ বিলিয়ন ডলার।
আর ঠিক এই গুরুত্বপূর্ণ সময়েই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্র সরকার সেমি কনডাক্টর ফিল্ডে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করল। সেই সঙ্গে জানা গিয়েছে এই ফিল্ডে আরও ৩০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আসবে। যাতে ভবিষ্যতে ভারত নিজেদের দেশেই পুরো একটি ইকোসিস্টেম তৈরি করতে পারে। অর্থনীতিবিদদের মতে, ভারতের অর্থনীতিকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে এই সেক্টর। আমাদের দেশ সেমিকন্ডাক্টরে প্রায় পুরোটাই বিদেশ থেকে আমদানি করে। তথ্য অনুযায়ী ২০২০ পর্যন্ত ভারতে সেমিকন্ডাক্টর আমদানি হয়েছে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের। ২০২৫ এর মধ্যে এটি বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলার। তাই এই ফিল্ডে সঠিক বিনিয়োগ করলে ২০২৫ এর মধ্যে আমাদের জিডিপি ৫ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ছুঁতে পারে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। একটি সেমিকন্ডাক্টর ইকোসিস্টেম তৈরিতে প্রধান অংশ হচ্ছে সিলকন ফ্যাব্রিকেশন যা দিয়ে এই চিপসেট তৈরি হয়। এরপর আসে ডিসপ্লে ম্যানুফাকচারিং, অর্থাৎ মোবাইল, ল্যাপটপ, টিভির ডিসপ্লে। তারপর আসে কমপাউন্ড সেমিকন্ডাক্টর যাতে সিলিকন কার্বাইড, গ্যালিয়াম নাইট্রাইড ব্যবহার করা হয়।কম্পাউন্ড সেমিকন্ডাক্টর ব্যবহার করা হয় গাড়ি, টেলিকম টাওয়ার ও রেল ইন্জিনে।
সরকারের এই বিনিয়োগের ফলে ম্যানুফ্যাকচারিং থেকে প্যাকেজিং- এই পুরো প্রসেস ভারতেই হবে। সবথেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এই মহূর্তে বিদেশের বড় বড় সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি তে যেসব ইন্জিনিয়ার রয়েছেন তার ২০ শতাংশই ভারতীয়। সুতারং এই ফিল্ডে ভারতীয় মগজাস্ত্রের অভাব নেই সেটা ভালই বোঝা যায়। পাশাপাশি মোদী সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ৮৫০০০ হাইলি কোয়াফাইড পড়ুয়াকে বিশেষভাবে ট্রেনিং দেওয়ার। এ জন্য স্পেশাল একটি প্যাকেজ তৈরি করা হয়েছে যার নাম সিটিএস (চিপ টু স্টার্টআপ)। সাধারণত একটি চিপসেট যত ছোট হয় তার ডিজাইনও তত ভাল হয়। পৃথিবীর অন্যতম সেরা ডিজাইনার ভারত থেকেই তৈরি হয়। এর জন্য ভারত সরকার একটি নতুন প্যাকেজ ঘোষনা করেছে। এই প্যাকেজের নাম ডিএলআই (ডিজাইন লিংকড ইনশেনটিভ)। এই প্যাকেজ অনুসারে একজন ডিজাইনার যাতে স্টার্টআপ তৈরি করতে পারে তার জন্য ভারত সরকার ৫০% আর্থিক সহায়তা করবে। এই মহূর্তে মোহালিতে ১৮০ ন্যানোমিটার প্ল্যান্ট রয়েছে। এই বিনিয়োগের ফলে সেখানে আরও ২৮-৪০ ন্যানোমিটার প্রোডাকশন বৃদ্ধি পাবে। ভারতের প্রাইভেট সেক্টর কোম্পানি গুলো এই কাজে এগিয়ে এসেছে।
টাটা গ্রুপ ৩০০ মিলিয়ন ডলারের একটি সেমিকন্ডাক্টর চিপসেট প্ল্যন্ট তৈরি করবে বলে সূত্র মারফত জানা গিয়েছে। ভেদান্ত গ্রুপ দক্ষিণ কোরিয়ার কোন কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে প্ল্যান্ট তৈরি করতে পারে বলেও জানা গিয়েছে। পাশাপাশি সাহাস্রা ইলেকট্রনিক্সও সেটআপ তৈরি করবে। তালিকায় রয়েছে আরও অনেক সংস্থা। ইতিমধ্যে মিনিস্ট্রি অফ ইলেকট্রনিক্স ও ইনফরমেশন টেকনোলজি জানিয়েছে, তাদের কাছে বিদেশের অন্তত ২০টি সংস্থার আবেদন রয়েছে ভারতে প্ল্যান্ট সেটআপের জন্য। সরকার কম সুদে লোন এবং জমিও দিতে পারে সংস্থাগুলিকে। পাশাপাশি কম্পাউড সেমি কনডাক্টর তৈরির ক্ষেত্রে ভারত সরকার ১৫-২০ টি বিশেষ ইউনিট তৈরি করবে। সরকার সূত্রে জানা গিয়েছে, এর ফলে ৩৫ হাজার উচ্চপ্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন কর্মীর চাকরি হবে। সেই সঙ্গে প্রয়োজন হবে এক লক্ষ অন্যান্য কর্মীরও। ভারত আগামী ২০ বছরের জন্য পুরো একটি ইকোসিস্টেম তৈরি করার পরিকল্পনা নিয়েছে এই ভাবে। সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি তৈরির ক্ষেত্রে এই মহূর্তে ভারতই সবচেয়ে ভাল অবস্থানে রয়েছে। এর বড় কারন জিও পলিটিক্স।
এতদিন সেমিকন্ডাক্টর চিপসেটের জন্য ভারত, আমেরিকা, ইউরোপ, চীন, তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়ার উপর নির্ভর করত। আমেরিকা ও চীনের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই এর জন্য চীনের উপর নির্ভরতা কমাতে প্রত্যেকটি দেশ নিজেদের ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করছে। এদিকে চীন ও তাইওয়ান এর মধ্যে বিরোধিতার সুযোগে ভারতও তাইওয়ানের সঙ্গে কথা বলছে যাতে সেমি কনডাক্টর প্ল্যান্ট ভারতে তৈরি করা যায়। তবে এই প্রকল্প সফল করা কিন্তু একদিনের বিষয় নয়। এর জন্য প্রয়োজন যথেষ্ট সময়। এর প্রধান কারন হল সেমি কন্ডাক্টটর টেকনোলজি অত্যন্ত জটিল। এই ধরনের হাইলি অ্যাডভান্সড টেকনোলজির জন্য প্রয়োজনীয় সেটআপ তৈরিতে সময় প্রচুর সময় লাগবে। এর জন্য হার্ডওয়্যার ও ইলেকট্রনিকস নির্মাণে এগিয়ে আসতে হবে স্থানীয় প্রাইভেট সংস্থাগুলোকে। সেই এছাড়াও আরও একটি প্রধান সমস্যা হল মেশিনারি। সেমিকন্ডাক্টর প্ল্যান্ট তৈরি করতে অনেক বড় বড় মেশিনারি লাগে। আগে একটা মেশিনারি আমদানি করতে লাগত ১৬ সপ্তাহ।
কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারির কারনে প্রত্যেক দেশ তাদের নিজস্ব ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করছে যার জন্য এখন একটি মেশিনারি অর্ডার দিলে আসতে সময় লেগে যাবে প্রায় ৬২ সপ্তাহ। ইউরোপে আগে সেকেন্ডহ্যান্ড মেশিন পাওয়া গেলেও চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সেটাও আর পাওয়া যাচ্ছে না। ২০২৫ এর মধ্যে ভারতে ৬০ বিলিয়ন ডলারের সেমিকন্ডাক্টর লাগবে। আর এ ক্ষেত্রে সরকারের মূল উদ্দেশ্য, ভারতের লক্ষ অন্তত ৩০ বিলিয়ন ডলারের প্রোডাক্ট ভারতে তৈরি করা। সুতরাং ভারত সরকারের এই স্কিম-এর সুফল পাওয়া যাবে ৩-৪ বছর পর থেকে। তবে মোদী সরকার যে কোনও প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য এতটাই দ্রুততার সঙ্গে কাজ করে যে সময় কম লাগাই স্বাভাবিক। এখন শুধু অপেক্ষা ভারতের সেমিকন্ডাক্টর পাওয়ার হাউস হয়ে ওঠার।
সূত্র : প্রথম কলকাতা

 


এ জাতীয় আরো খবর