শ্রীমঙ্গল, (মৌলভীবাজার) ৫ ফেব্রুয়ারি : ষড় ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু এই ঋতু বৈচিত্রের সুবিধাগুলো পুরোপুরি উপভোগ করতে পারে না সকল এলাকার মানুষ। নদীমাতৃক এই বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলের জনগোষ্টীর কাছে বর্ষাকালটি বেশ উপভোগ্য। কারণ তাদের যাতায়াতের অন্যতম বাহন নৌকা এবং জীবিকার অন্যতম উৎস মাছধরা ও বোরো ধান ফলানো এই ভরা মৌসুমেই চলে ভালো। কিন্তু কারো জন্য যখন বর্ষা কামনার ধন ঠিক তখন শহরবাসীর জন্য তা অনেক সময় বিরক্তিকর। কারণ অনেক জায়গায় অপরিকল্পিত ভাবে নগরায়নের ফলে ড্রেনেজ ব্যবস্থার দুর্বলতায় ফ্লাসফ্লাডে সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দাগণ হন নাকাল । পানিতে ডুবে যাওয়া পাকা রাস্তায় তখন গাড়ির পাশে নৌকা চলাচলের দৃশ্য পত্রিকার পাতায় চোখে পড়ে। কিন্তু অদম্য মনোবল আর অভিযোজন প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত এই দেশের মানুষ এসব কিছু সামলে নিয়েই যুগ যুগ ধরে চলছে।
কিন্তু মহাকালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে ভাটি বাংলার লোকজ কিছু শিল্প-সংস্কৃতি। তেমনি একটি শিল্প হচ্ছে জ্বালানী শিল্প। গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে হাওর বাওর নদীবেষ্টিত জনপদের একসময়ের জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় বিশেষ মৌসুমে বাড়ির আঙিনা জুড়ে গবাদি পশু বিশেষ করে গরু এবং মহিষের গোবর এবং বাঁশের টুকরো কিংবা জলাভূমিতে গজিয়ে উঠা ঢোল কলমি’র শাখার সাথে ধানের চিটা বা ভূষি অথবা খড়ের সাহায্যে তৈরি গোমইট (বাঁশের টুকরোর উপর গোবরের প্রলেপ দিয়ে তার উপর ধানের চিটা বা ভূষি ছিটিয়ে তৈরি এক বিশেষ ধরণের জ্বালানি) এবং গোবর ছটা (ধানের খড় বিছিয়ে তার উপরে গোবর লেপে দিয়ে এরপর ধানের চিটা বা ভূষি ছিটিয়ে গোলাকৃতি বা চৌকোনা আকৃতির করে কেটে তৈরি এক বিশেষ ধরণের জ্বালানি) শুকোতে দেয়া হত। বাড়ির সকল বয়সী সদসদের অংশগ্রহণে তৈরি এই জ্বালানি শুকিয়ে যাওয়ার পর স্তরে স্তরে সাজিয়ে রাখা বসতঘরের বাঁশের কিংবা ইকরের (বিশেষ ধরণের গাছ) বেড়ার সাথে, যাতে বৃষ্টিতে ভিজে না যায়। এই গোমইট বা গোবর ছটা তৈরিতে নতুনত্ব নিয়ে আসার জন্য এর নির্মাতাগণ এগুলোর বিভিন্ন আকৃতি দিতেন যা ছোট-বড় সবাইকে আকর্ষণ করতো এবং সবার মধ্যে এসব আকৃতিতে এসব জ্বালানি তৈরির প্রচন্ড আগ্রহ সৃষ্টি হতো।
মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে হাইল হাওরের ভেতরে ঘোষ পল্লীর গরু-মহিষ বাতানের লোকেরাও একসময় বছরের বিশেষ মৌসুমে জ্বালানি হিসেবে এগুলো (গোমইট এবং গোবর ছটা) ব্যবহার করতেন। ফিসারির সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে উন্মুক্ত গোচারণভুমি ক্রমশ: সংকোচিত হওয়ায় হাওরের বুকে থাকা সেই ঘোষ পল্লীর মৌসুমী ঘোষদের আজ এসব কর্মে দেখা যায় না, তাঁরাও সময়ের সাথে সাথে অন্য জীবিকা বেছে নিয়েছেন। তাই এখন আর আগুনে স্যাঁকে বাঁকানো বাঁশের তৈরি ভাড়ে করে নিয়ে আসা সেই বাতানের লোকদের ফেরি করে দুধ-দই বিক্রয় করতে দেখা যায় না। বৃহত্তর সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানে এখনও এই জ্বালানি শিল্পের (গোমইট এবং গোবর ছটা) দেখা পাওয়া যায়। বিজ্ঞানের জয় যাত্রায় বিদ্যুৎ এবং গ্যাস সিলিন্ডারের প্রচলনে জনজীবনে উন্নয়ণের ছোঁয়া লেগেছে। বিকল্প জ্বালানির সন্ধান পাওয়ায় এখন আর প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বাড়ির আঙিনা কিংবা মেঁটো রাস্তার কিনার ঘেষে পূর্বের মতো সারি বেঁধে রাখা গোমইট এবং গোবর ছটার দেখা পাওয়া যায় না। তাছাড়া বেশ কয়েক বছর ধরে সফল বৃক্ষরোপন অভিযান পরিচালনার ফলে এখন জ্বালানি কাঠের সংকট ক্রমশ: দূর হচ্ছে। তবুও প্রত্যন্ত এলাকায় যেখানে সড়ক যোগাযোগ ততটা আধুনিক নয় কিংবা গ্যাস সিলিন্ডার পৌঁছানোর সুযোগ নেই কিংবা বাড়ির চারপাশে পর্যাপ্ত গাছ লাগোনোর জায়গা নেই সেই সব স্থানে টিকে আছে এই জ্বালানি শিল্পটি। হয়তো কালের পরিক্রমায় একসময় হারিয়ে যাবে এই শিল্পটি তারপরও গ্রামবাংলার জ্বালানি কাঠের সংকট মোচনে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে গোমইট এবং গোবর ছটা তৈরির কারিগরদের প্রতি দীর্ঘকাল আমাদের শ্রদ্ধা থাকবে।
লেখক : রজত শুভ্র চক্রবর্তী, সহকারী অধ্যাপক, দ্বারিকা পাল মহিলা কলেজ শ্রীমঙ্গল।