
কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবি বলেই বাংলা সাহিত্যে সমধিক পরিচিত। রবীন্দ্রনাথের কবিজীবনের চরম উৎকর্ষের সময় তিনি বিদ্রোহের উচ্চকণ্ঠ এবং উদ্দামতা নিয়ে 'অগ্নিবীণা' হাতে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে প্রবেশ করেন। কিন্তু এই বিদ্রোহই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। তাঁর বিদ্রোহের সাথে রোমান্টিক প্রেমানুভূতির অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। তিনি একাধারে বিদ্রোহী কবি, প্রেমের কবি, মানুষের কবি, সাম্যের কবি, প্রকৃতির কবি।তাঁর কাব্যভুবনে রুদ্রভীষণের সাথে কোমল মধুরের ভাবপরিণয় সত্যিই বিস্ময়কর।
সুবিখ্যাত' বিদ্রোহী' কবিতায় কবি বলেন, " মম একহাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য। "আপাত বিরোধী দুটো বিষয়ের এজাতীয় সহাবস্থান বা সমবর্তিতা নজরুল কাব্যে দীপ্র। তাঁর সম্পর্কে বলা যায়, যিনি বিদ্রোহী, তিনিই শ্রেষ্ঠ প্রেমিক। তাঁর প্রেমরঞ্জক হৃদয় শতধারায় অভিব্যক্ত হয়েছে 'দোলনচাঁপা' কাব্যে।ভরা বর্ষার কূলপ্লাবী নদী হয়ে কবির প্রেমানুভব এ কাব্যের ছত্রে ছত্রে কল্লোলিত।
'অগ্নিবীণা,র পর প্রকাশিত দোলনচাঁপা দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ (প্রকাশকাল ১৯২৩) বিষয়ে ব্রজবিহারী বর্মণ বলেন, "প্রেসিডেন্সি জেলে অবস্থানকালেই কবি তাঁর চতুর্থ বই 'দোলনচাঁপা' রচনা করেন। জেল কর্তৃপক্ষের অগোচরে তাঁর সবগুলো কবিতাই বাইরে পাচার করে দেওয়া হয়।" ১
নিসর্গের কোমলমধুর আলিম্পনে নজরুলকাব্য বিচিত্রমাত্রিক, ভাব তন্ময় এবং হৃদয়রঞ্জক।
প্রকৃতির মাঝে আত্মভাব বিস্তার এবং একইসাথে প্রকৃতি তথা নিসর্গের বিচিত্র উপাদানের সান্নিধ্যে অন্তর ভাবনার উন্মোচন রোমান্টিক কবিদের সহজাত বৈশিষ্ট্য। কবি মাত্রেই প্রকৃতিপ্রেমিক, নজরুলও এর ব্যতিক্রম নন।
'দোলনচাঁপা', কাব্যে দেখা যায়, প্রেম এবং প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তাঁর বিশিষ্ট শিল্পব্যক্তিত্বের সোনারকাঠির ছোঁয়ায় প্রকৃতিবাঁশি 'দোলনচাঁপা'য়
বেজে চলেছে নিরন্তর।
'অগ্নিবীণা'য় জগতের সকল অন্যায়, অবিচার, অসত্য, অসাম্য, কুসংস্কার এবং ভণ্ডামির বিরুদ্ধে কবি বিদ্রোহে ছিলেন উচ্চকণ্ঠ,
"বল বীর
চির উন্নত মম শির।
শির নেহারি আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রীর।"
(বিদ্রোহী)
এই উদ্দাম বিদ্রোহের পরেই 'দোলনচাঁপা'য় কবিকে দেখি একজন নিবেদিতপ্রাণ প্রেমিকরূপে। এ কাব্যে কবি প্রেমে উদ্বেল। আবার কখনো বিরহে পরিম্লান, বিধুর। এখানে নজরুলের কবিমানস প্রেম ও সৌন্দর্যের দীপ্র আলোকে উদ্ভাসিত। যৌবন -স্বপ্নই নজরুলকে সৌন্দর্য প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করেছে। যে সৌন্দর্য ভোগে, মিলনে এবং প্রকৃতিতে। 'দোলনচাঁপা' কাব্যে নজরুলের গভীর প্রকৃতিপ্রেম হিরণ্ময় আলোকে দীপ্ত।
'বেলা শেষে 'কবিতায় প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর পটভূমিকায় বেদনার সকরুণ মূর্ছনা শোনা যায়। সেখানে ধরণী তার গাঢ় বেদনার আঁচলটি দিগন্তের কোলে যেন ছড়িয়ে দিয়েছে। পাখি উড়ে যাচ্ছে। ধীর পায়ে বিষাদ কাতর রঙ মেখে নামছে সন্ধ্যা।সমস্ত বিশ্বচরাচর আজ বুঝি অনন্ত বিষণ্নতায় নিমগ্ন। আকাশের অস্ত বাতায়নে অনন্ত বিরহ বুকে নিয়ে কে যেন কার পথ চেয়ে আছে,
"ক্রমে নিশীথিনী আসে ছড়াইয়া ধূলায় মলিন এলোচুল,
সন্ধ্যাতারা নিভে যায়, হারা হয় দিবসের কূল।
এ কবিতায় অনাদৃত, অবহেলিত বিরহী হৃদয়ের বেদনা, একাকীত্ব, অন্তরের নিতল আর্তি সন্ধ্যার ম্লান প্রকৃতির সাথে একাত্মহয়ে এক বিষাদকাতর আবহ সৃষ্টি করেছে।
'পউষ' কবিতায় কবি পৌষের এক কাব্যমধুর চিত্র অংকন করেছেন, যা সুগভীর প্রকৃতিপ্রেমের সাথে কাঙ্ক্ষিতের বিরহ বেদনায় সকরুণ,
"সে এলো আর পাতায় পাতায় হায়/
বিদায় ব্যথা যায়গো কেঁদে যায়, /
অস্ত্ বধূ মলিন চোখে চায় /
পথ চাওয়া দীপ সন্ধ্যা - তারায় হারায়ে। /" ---
'পথহারা' কবিতায় প্রেমিক কবি বিরহী পথিকের অসহায়ত্বের চিত্র আঁকতে গিয়ে প্রকৃতিকেই অবলম্বন করেছেন। বেলা শেষের ম্লান আলোছায়ায় একলা পথিক আপন নিঃসঙ্গতাকে উপলব্ধি করে বেদনা-বিহ্বল,
"ঘরে এসো সন্ধ্যা সবায় ডাকে
'নয় তোরে নয়, 'বলে একা তাকে ---"
এদিকে বনেরছায়া গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে।আঁধার ঘনায়। উদাসপথিক তবু প্রশান্তিরঘর খুঁজে পায় না।
'অবেলার ডাক' কবিতায় এক বিরহী নারীর কোমল হৃদয়ের প্রতিবিম্ব প্রকৃতির মুকুরে উদ্ভাসিত। যে প্রেম দুবাহু বাড়ায়ে আঁকড়ে ধরতে চায়। নিমজ্জিত হয় প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্যে। কবি এখানে যাঁর চিত্র এঁকেছেন, তিনি তাঁর ভালোবাসার মানুষকে হৃদয়ের নিভৃতে প্রকৃতির একাত্মতায় অনুভব করেছেন,
"ফুলের সাথে ফুটে বেড়ায়
মেঘের সাথে যায় পাহাড়ে
ধরা দিয়েও দেয় না ধরা
জানিনা সে চায় কাহারে। "
এ কবিতায়ও এক বিরহী হৃদয়ের অতলান্ত আর্তি প্রকৃতির আশ্রয়ে বিকশিত হয়েছে।
'দোলনচাঁপা 'কাব্যে বিচিত্র প্রণয়লীলা, অনুরাগ, বিরাগ, প্রশংসা, মান- অভিমান, ইত্যাদি সবরকম ভাবই বিন্যস্ত হয়েছে। প্রেমিককবি প্রকৃতির মাঝে নব নব রূপে প্রেমকে উপলব্ধি করেছেন । কখনো এ উপলব্ধি তাঁকে বেদনাবিদ্ধ করেছে , আবার কখনো আনন্দের বরণডালা সাজিয়ে সংবেদনশীল চিত্তকে আন্দোলিত করেছে। কবির আনন্দ-বেদনার সহযাত্রী হয়েছে উদার বিস্তৃত প্রকৃতি।এককথায় 'দোলনচাঁপা'য় প্রকৃতি -প্রেমে কবি বিভোর।
'পূজারিণী' এ কাব্যের শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা। কবির প্রেমানুভূতির শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। পূজারিণী কবির জীবন্ত মানস প্রতিমা। এ কবিতায় প্রেম রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে কবি দুজনের জন্ম-জন্মান্তরের মিলন-বিরহ, আশা-নৈরাশ্য, মান-অভিমান প্রভৃতির দ্বন্দ্বমুখর ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। কবি প্রেয়সীকে পূজারিণী কল্পনা করাতে প্রেমের একটা পবিত্র রূপ ফুটে ওঠেছে।
পূজারিণীর পরিচয়ে কবি বলেন,
'চিরপরিচিতা তুমি জন্ম জন্ম ধরে মোর অনাদৃতা সীতা।"
এ কবিতায় কবির নারীপ্রেম ও প্রকৃতি প্রেম দিব্যরাগে বিভাসিত। আপন হৃদয়াবেগ ব্যক্ত করতে গিয়ে কবি বলেন,
খুঁজে ফিরি কোথা হতে এই ব্যথা ভারাতুর মদগন্ধ আসে/
আকাশ, বাতাস, ধরা কেঁপে কেঁপে ওঠে শুধু মোর তপ্ত ঘন দীর্ঘশ্বাসে।/
কেঁদে ওঠে লতা-পাতা
ফুল পাখি নদীজল,
মেঘ, বায়ু কাঁদে সবই অবিরল।"
'আশান্বিতা' কবিতায় প্রেমের চিরন্তন আশ্বাসের সুর ধ্বনিত।প্রেমিকা জানে তাঁর নাথ একদিন ডাকে সাড়া দেবেই। তাই প্রত্যাশার দরজা খুলে অন্তহীন তাঁর পথ চাওয়া আশায় আশায় উদ্বেল। এ আশাবাদ ব্যক্ত হয়েছে প্রকৃতির আশ্রয়ে—
"আসবে আবার পদ্মা নদী, দুলবে তরী ঢেউদোলায় /
তেমনি করে দুলবো আমি তোমার বুকের পরকোলায় । /"
'কবি-রাণী 'কবিতায় নজরুল তাঁর কবিতার উৎস সন্ধানে তৎপর । কবি-রাণী কবি -প্রেমের অমৃতময় মানসী। যার সংস্পর্শে কবিতার উৎসমুখ খুলে যায়। বিদ্রোহের কঠোর অসিতে জাগে বাঁশির ললিতমোহন মূর্ছনা । একই সাথে প্রকৃতির সাথেও কবি গভীর একাত্মতা খুঁজে পান। তাঁর মনে হয়,
"আপন জেনে হাত বাড়ালো
আকাশ, বাতাস প্রভাত আলো
বিদায় বেলার সন্ধ্যাতারা পুবের অরুণ রবি
তুমি ভালোবাসো বলে ভালোবাসে সবি।
এখানে মানসীর প্রেমদর্পণে কবি আত্মস্বরূপের প্রতিফলন দেখতে পান। বলা বাহুল্য, এসব অংশে নজরুলের প্রকৃতিপ্রীতি শতধারায় উৎসারিত।
নজরুলের প্রেম নির্ভর কাব্য 'দোলনচাঁপা 'থেকে এ কথা প্রতীয়মান হয়, এ কাব্যে কবি একান্তভাবেই শান্ত, কোমল এবং নিসর্গলগ্ন। তাঁর রোমান্টিক চিন্তাচেতনা প্রকৃতি ভাবনার সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত । তাঁর হৃদয় প্রকৃতিতে বিচরণশীল। প্রকৃতি -নীড়েরমাঝে কবি শান্তি খুঁজে বেড়ান। এজন্যই পৌষের কুয়াশা কবি র বিবর্ণ, বিষণ্ণ হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি হয়ে আসে । আকাশের তারকারাজি, সোনার সিঁদুর ছড়ানো নিঝুম সন্ধ্যা কবির বিরহ যাতনাকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে তোলে। 'দোলনচাঁপা'য় বিদ্রোহের মহাকল্লোল নেই, আছে প্রেমের বিচিত্র মধুর উদ্ভাস। এ প্রসঙ্গে আমরা ড . সুশীল কুমার এঁর উক্তি চয়ন করব,
"অগ্নিবীণাধারী বিদ্রোহী কবির মর্ম লোকে যে প্রেমের পিপাসা অতৃপ্ত অবস্থায় কেঁদে ফিরছিল, তাই এই গ্রন্থে অসামান্য কাব্য প্রেরণা হয়ে উঠেছে ।" ২"
বস্তুত, 'দোলনচাঁপা 'কাব্যে নজরুলের প্রেমানুভব প্রকৃতির বিচিত্র মধুর উদ্ভাসে এক অন্যরকম প্রদীপ্তি লাভ করেছে।
তথ্যসূত্র
১. সুশীলকুমার গুপ্ত, নজরুল চরিত মানস।
২. পূর্বোক্ত
সহায়ক গ্রন্থ
১. নজরুল রচনাবলি,
আব্দুল কাদির সম্পাদিত।
২. নজরুল- চর্চা,
নারায়ণ চৌধুরী।
লেখক : জাহান আরা খাতুন
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ
হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ হবিগঞ্জ।
সুবিখ্যাত' বিদ্রোহী' কবিতায় কবি বলেন, " মম একহাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য। "আপাত বিরোধী দুটো বিষয়ের এজাতীয় সহাবস্থান বা সমবর্তিতা নজরুল কাব্যে দীপ্র। তাঁর সম্পর্কে বলা যায়, যিনি বিদ্রোহী, তিনিই শ্রেষ্ঠ প্রেমিক। তাঁর প্রেমরঞ্জক হৃদয় শতধারায় অভিব্যক্ত হয়েছে 'দোলনচাঁপা' কাব্যে।ভরা বর্ষার কূলপ্লাবী নদী হয়ে কবির প্রেমানুভব এ কাব্যের ছত্রে ছত্রে কল্লোলিত।
'অগ্নিবীণা,র পর প্রকাশিত দোলনচাঁপা দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ (প্রকাশকাল ১৯২৩) বিষয়ে ব্রজবিহারী বর্মণ বলেন, "প্রেসিডেন্সি জেলে অবস্থানকালেই কবি তাঁর চতুর্থ বই 'দোলনচাঁপা' রচনা করেন। জেল কর্তৃপক্ষের অগোচরে তাঁর সবগুলো কবিতাই বাইরে পাচার করে দেওয়া হয়।" ১
নিসর্গের কোমলমধুর আলিম্পনে নজরুলকাব্য বিচিত্রমাত্রিক, ভাব তন্ময় এবং হৃদয়রঞ্জক।
প্রকৃতির মাঝে আত্মভাব বিস্তার এবং একইসাথে প্রকৃতি তথা নিসর্গের বিচিত্র উপাদানের সান্নিধ্যে অন্তর ভাবনার উন্মোচন রোমান্টিক কবিদের সহজাত বৈশিষ্ট্য। কবি মাত্রেই প্রকৃতিপ্রেমিক, নজরুলও এর ব্যতিক্রম নন।
'দোলনচাঁপা', কাব্যে দেখা যায়, প্রেম এবং প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তাঁর বিশিষ্ট শিল্পব্যক্তিত্বের সোনারকাঠির ছোঁয়ায় প্রকৃতিবাঁশি 'দোলনচাঁপা'য়
বেজে চলেছে নিরন্তর।
'অগ্নিবীণা'য় জগতের সকল অন্যায়, অবিচার, অসত্য, অসাম্য, কুসংস্কার এবং ভণ্ডামির বিরুদ্ধে কবি বিদ্রোহে ছিলেন উচ্চকণ্ঠ,
"বল বীর
চির উন্নত মম শির।
শির নেহারি আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রীর।"
(বিদ্রোহী)
এই উদ্দাম বিদ্রোহের পরেই 'দোলনচাঁপা'য় কবিকে দেখি একজন নিবেদিতপ্রাণ প্রেমিকরূপে। এ কাব্যে কবি প্রেমে উদ্বেল। আবার কখনো বিরহে পরিম্লান, বিধুর। এখানে নজরুলের কবিমানস প্রেম ও সৌন্দর্যের দীপ্র আলোকে উদ্ভাসিত। যৌবন -স্বপ্নই নজরুলকে সৌন্দর্য প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করেছে। যে সৌন্দর্য ভোগে, মিলনে এবং প্রকৃতিতে। 'দোলনচাঁপা' কাব্যে নজরুলের গভীর প্রকৃতিপ্রেম হিরণ্ময় আলোকে দীপ্ত।
'বেলা শেষে 'কবিতায় প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর পটভূমিকায় বেদনার সকরুণ মূর্ছনা শোনা যায়। সেখানে ধরণী তার গাঢ় বেদনার আঁচলটি দিগন্তের কোলে যেন ছড়িয়ে দিয়েছে। পাখি উড়ে যাচ্ছে। ধীর পায়ে বিষাদ কাতর রঙ মেখে নামছে সন্ধ্যা।সমস্ত বিশ্বচরাচর আজ বুঝি অনন্ত বিষণ্নতায় নিমগ্ন। আকাশের অস্ত বাতায়নে অনন্ত বিরহ বুকে নিয়ে কে যেন কার পথ চেয়ে আছে,
"ক্রমে নিশীথিনী আসে ছড়াইয়া ধূলায় মলিন এলোচুল,
সন্ধ্যাতারা নিভে যায়, হারা হয় দিবসের কূল।
এ কবিতায় অনাদৃত, অবহেলিত বিরহী হৃদয়ের বেদনা, একাকীত্ব, অন্তরের নিতল আর্তি সন্ধ্যার ম্লান প্রকৃতির সাথে একাত্মহয়ে এক বিষাদকাতর আবহ সৃষ্টি করেছে।
'পউষ' কবিতায় কবি পৌষের এক কাব্যমধুর চিত্র অংকন করেছেন, যা সুগভীর প্রকৃতিপ্রেমের সাথে কাঙ্ক্ষিতের বিরহ বেদনায় সকরুণ,
"সে এলো আর পাতায় পাতায় হায়/
বিদায় ব্যথা যায়গো কেঁদে যায়, /
অস্ত্ বধূ মলিন চোখে চায় /
পথ চাওয়া দীপ সন্ধ্যা - তারায় হারায়ে। /" ---
'পথহারা' কবিতায় প্রেমিক কবি বিরহী পথিকের অসহায়ত্বের চিত্র আঁকতে গিয়ে প্রকৃতিকেই অবলম্বন করেছেন। বেলা শেষের ম্লান আলোছায়ায় একলা পথিক আপন নিঃসঙ্গতাকে উপলব্ধি করে বেদনা-বিহ্বল,
"ঘরে এসো সন্ধ্যা সবায় ডাকে
'নয় তোরে নয়, 'বলে একা তাকে ---"
এদিকে বনেরছায়া গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে।আঁধার ঘনায়। উদাসপথিক তবু প্রশান্তিরঘর খুঁজে পায় না।
'অবেলার ডাক' কবিতায় এক বিরহী নারীর কোমল হৃদয়ের প্রতিবিম্ব প্রকৃতির মুকুরে উদ্ভাসিত। যে প্রেম দুবাহু বাড়ায়ে আঁকড়ে ধরতে চায়। নিমজ্জিত হয় প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্যে। কবি এখানে যাঁর চিত্র এঁকেছেন, তিনি তাঁর ভালোবাসার মানুষকে হৃদয়ের নিভৃতে প্রকৃতির একাত্মতায় অনুভব করেছেন,
"ফুলের সাথে ফুটে বেড়ায়
মেঘের সাথে যায় পাহাড়ে
ধরা দিয়েও দেয় না ধরা
জানিনা সে চায় কাহারে। "
এ কবিতায়ও এক বিরহী হৃদয়ের অতলান্ত আর্তি প্রকৃতির আশ্রয়ে বিকশিত হয়েছে।
'দোলনচাঁপা 'কাব্যে বিচিত্র প্রণয়লীলা, অনুরাগ, বিরাগ, প্রশংসা, মান- অভিমান, ইত্যাদি সবরকম ভাবই বিন্যস্ত হয়েছে। প্রেমিককবি প্রকৃতির মাঝে নব নব রূপে প্রেমকে উপলব্ধি করেছেন । কখনো এ উপলব্ধি তাঁকে বেদনাবিদ্ধ করেছে , আবার কখনো আনন্দের বরণডালা সাজিয়ে সংবেদনশীল চিত্তকে আন্দোলিত করেছে। কবির আনন্দ-বেদনার সহযাত্রী হয়েছে উদার বিস্তৃত প্রকৃতি।এককথায় 'দোলনচাঁপা'য় প্রকৃতি -প্রেমে কবি বিভোর।
'পূজারিণী' এ কাব্যের শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা। কবির প্রেমানুভূতির শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। পূজারিণী কবির জীবন্ত মানস প্রতিমা। এ কবিতায় প্রেম রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে কবি দুজনের জন্ম-জন্মান্তরের মিলন-বিরহ, আশা-নৈরাশ্য, মান-অভিমান প্রভৃতির দ্বন্দ্বমুখর ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। কবি প্রেয়সীকে পূজারিণী কল্পনা করাতে প্রেমের একটা পবিত্র রূপ ফুটে ওঠেছে।
পূজারিণীর পরিচয়ে কবি বলেন,
'চিরপরিচিতা তুমি জন্ম জন্ম ধরে মোর অনাদৃতা সীতা।"
এ কবিতায় কবির নারীপ্রেম ও প্রকৃতি প্রেম দিব্যরাগে বিভাসিত। আপন হৃদয়াবেগ ব্যক্ত করতে গিয়ে কবি বলেন,
খুঁজে ফিরি কোথা হতে এই ব্যথা ভারাতুর মদগন্ধ আসে/
আকাশ, বাতাস, ধরা কেঁপে কেঁপে ওঠে শুধু মোর তপ্ত ঘন দীর্ঘশ্বাসে।/
কেঁদে ওঠে লতা-পাতা
ফুল পাখি নদীজল,
মেঘ, বায়ু কাঁদে সবই অবিরল।"
'আশান্বিতা' কবিতায় প্রেমের চিরন্তন আশ্বাসের সুর ধ্বনিত।প্রেমিকা জানে তাঁর নাথ একদিন ডাকে সাড়া দেবেই। তাই প্রত্যাশার দরজা খুলে অন্তহীন তাঁর পথ চাওয়া আশায় আশায় উদ্বেল। এ আশাবাদ ব্যক্ত হয়েছে প্রকৃতির আশ্রয়ে—
"আসবে আবার পদ্মা নদী, দুলবে তরী ঢেউদোলায় /
তেমনি করে দুলবো আমি তোমার বুকের পরকোলায় । /"
'কবি-রাণী 'কবিতায় নজরুল তাঁর কবিতার উৎস সন্ধানে তৎপর । কবি-রাণী কবি -প্রেমের অমৃতময় মানসী। যার সংস্পর্শে কবিতার উৎসমুখ খুলে যায়। বিদ্রোহের কঠোর অসিতে জাগে বাঁশির ললিতমোহন মূর্ছনা । একই সাথে প্রকৃতির সাথেও কবি গভীর একাত্মতা খুঁজে পান। তাঁর মনে হয়,
"আপন জেনে হাত বাড়ালো
আকাশ, বাতাস প্রভাত আলো
বিদায় বেলার সন্ধ্যাতারা পুবের অরুণ রবি
তুমি ভালোবাসো বলে ভালোবাসে সবি।
এখানে মানসীর প্রেমদর্পণে কবি আত্মস্বরূপের প্রতিফলন দেখতে পান। বলা বাহুল্য, এসব অংশে নজরুলের প্রকৃতিপ্রীতি শতধারায় উৎসারিত।
নজরুলের প্রেম নির্ভর কাব্য 'দোলনচাঁপা 'থেকে এ কথা প্রতীয়মান হয়, এ কাব্যে কবি একান্তভাবেই শান্ত, কোমল এবং নিসর্গলগ্ন। তাঁর রোমান্টিক চিন্তাচেতনা প্রকৃতি ভাবনার সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত । তাঁর হৃদয় প্রকৃতিতে বিচরণশীল। প্রকৃতি -নীড়েরমাঝে কবি শান্তি খুঁজে বেড়ান। এজন্যই পৌষের কুয়াশা কবি র বিবর্ণ, বিষণ্ণ হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি হয়ে আসে । আকাশের তারকারাজি, সোনার সিঁদুর ছড়ানো নিঝুম সন্ধ্যা কবির বিরহ যাতনাকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে তোলে। 'দোলনচাঁপা'য় বিদ্রোহের মহাকল্লোল নেই, আছে প্রেমের বিচিত্র মধুর উদ্ভাস। এ প্রসঙ্গে আমরা ড . সুশীল কুমার এঁর উক্তি চয়ন করব,
"অগ্নিবীণাধারী বিদ্রোহী কবির মর্ম লোকে যে প্রেমের পিপাসা অতৃপ্ত অবস্থায় কেঁদে ফিরছিল, তাই এই গ্রন্থে অসামান্য কাব্য প্রেরণা হয়ে উঠেছে ।" ২"
বস্তুত, 'দোলনচাঁপা 'কাব্যে নজরুলের প্রেমানুভব প্রকৃতির বিচিত্র মধুর উদ্ভাসে এক অন্যরকম প্রদীপ্তি লাভ করেছে।
তথ্যসূত্র
১. সুশীলকুমার গুপ্ত, নজরুল চরিত মানস।
২. পূর্বোক্ত
সহায়ক গ্রন্থ
১. নজরুল রচনাবলি,
আব্দুল কাদির সম্পাদিত।
২. নজরুল- চর্চা,
নারায়ণ চৌধুরী।
লেখক : জাহান আরা খাতুন
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ
হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ হবিগঞ্জ।