
গীতাঞ্জলি অধ্যাত্ম উপলব্ধির হিরণ্ময় উদ্ভাস। পরম রসময়কে পাওয়ার আকুলতায় কবির আকাশস্পর্শী আকাঙ্ক্ষা, আর না পাওয়ার দিগন্তস্পর্শী আর্তি এ কাব্যে অমৃত-ব্যঞ্জনায় পুষ্পিত।
গীতাঞ্জলিতে সাধনার ব্যাপ্তি, বেদনার অসীমতা, বিরহের ব্যাকুলতা বিচিত্র বর্ণচ্ছটায় দীপ্র। রবীন্দ্রনাথের অধ্যাত্মদৃষ্টি এই বিপুল বিশ্বের সবকিছুতেই অরূপ রতনের সুগভীর সুরমূর্ছনা শুনতে পেয়েছে। জীবন ও নিসর্গের বিচিত্র রূপের মধ্যে এক নিত্য অপরূপের লীলা বিভঙ্গ তাঁকে প্রতিনিয়ত অস্থির আকুল করে রেখেছে। যেন কিছুতেই দেবতার সান্নিধ্য লাভ হচ্ছে না। কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না পরম ভালোবাসার ধন। এ কারণে নিতল হাহাকারে গীতাঞ্জলির বহু গান অশ্রু-সজল। তিনি প্রকৃতির কবি বলে বারবার তাঁর অধ্যাত্মবোধের অবলম্বন হয়েছে প্রকৃতির বিচিত্র প্রকাশ। এ প্রসঙ্গে নীহাররঞ্জন রায় বলেন, "রবীন্দ্রনাথ জীবনের ও নিসর্গের সকল রূপের মধ্যে এক নিত্য অপরূপের লীলাই দেখিয়াছেন।সেই জন্যই তাঁহার অধ্যাত্ম মানসের আশ্রয় হইতেছে প্রকৃতির বিচিত্র প্রকাশ।"
অন্যান্য বিষয়ের সাথে তাঁর প্রকৃতি বিষয়ক সংগীত-বৈভব বাংলা কাব্যসংগীতকে নান্দনিকতায় অপূর্ব শ্রী দান করেছে। তাঁর মতো আর কোনো বাঙালি গীতিকার সংগীতকে অমিয় রসসিঞ্চনে এমন কান্ত মধুর করে তুলতে পারেন নি । এক্ষেত্রে তিনি বিস্ময়করভাবে অদ্বিতীয়। প্রকৃতির সঙ্গে নিতল সম্পর্কবোধেঋদ্ধ এসব গানকে রবীন্দ্র সমালোচক বলেছেন ঋতু সংগীত। মূলত প্রকৃতির সাথে সংগীতের সম্পর্ক অতি সুনিবিড়।
এ প্রসঙ্গে করুণাময় গোস্বামীর তথ্যসমৃদ্ধ বক্তব্যটি স্মরণযোগ্য, "প্রকৃতি যে মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী, মানুষের অনুভূতির অন্তহীন তরঙ্গমালাযে প্রকৃতির তরঙ্গের সাথে যুক্ত, সে কথা আমরা রবীন্দ্রনাথের গানে পাই। রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতির গানের সংখ্যা প্রায় ৩০০। গীতবিতানের প্রকৃতির গান পাওয়া যায় সংখ্যায় ২৮৩। শরৎ ঋতু নিয়ে কবির গান ৩০টি। তিনি শরতের শ্রেষ্ঠতম বাঙালি কবি। আনন্দ, বেরিয়ে পড়া, ছুটি এসবই হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের শরতের গানের মূলভাব।" এবার আমরা গীতাঞ্জলি কাব্যে শরৎ ঋতুর প্রতিফলন বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করব ।
ভগবৎ প্রেমে কবি যখন পরানসখা বন্ধুর সাথে মিলনের তৃষায় আকুল, তখনও শরতের সৌন্দর্য, মাধুর্যে তিনি বিমুগ্ধ। এসব গানে অধ্যাত্ম অনুভূতির ভাবতন্ময়তা ছাড়িয়ে প্রকৃতিপ্রীতিই দিব্যরাগে স্ফুট। রস ব্যঞ্জনায় অত্যন্ত গভীর এসব গানে ভাব-বৈভবেরসাথে চিত্র গরিমার স্নিগ্ধশ্রী বর্ণিল বিচিত্রতায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেছে। যেমন, "আজ ধানের খেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরি খেলা। নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা।--- ওরে যাবনা আজ ঘরেরে ভাই যাবনা আজ ঘরে! ওরে আকাশ ভেঙে বাহিরকে আজ নেবরে লুট করে।"(৮ নং গান)
জগৎ জীবন সম্পর্কে নিরাসক্ত কবি গীতাঞ্জলিতে যেখানে পরম দেবতার সন্ধানে তৎপর, যেখানে তিনি নিবেদনে কম্পিত, যেখানে বিরহের সকরুণ রাগিণী নিরন্তর বেজে চলেছে সেই গীতাঞ্জলিতেই আবার ভিন্ন ব্যঞ্জনা। এখানে বেজে উঠে আনন্দের বাঁশি। সুখের অমল সংগীত।
এখানে যেন ভাবতন্ময়তা ছেড়ে কবি -মন আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠেছে–" শরতে আজ কোন অতিথি এল প্রাণের দ্বারে
আনন্দ গান গারে হৃদয়
আনন্দ গান গা রে।"(৩৮নং গান)
গীতাঞ্জলির অনেক গানে নিসর্গানুভূতি উজ্জ্বলরূপে বিকশিত এ কথা বলাই বাহুল্য।ঈশ্বর চেতনা এখানে প্রচ্ছন্ন। এ কারণে ভাবতন্ময়তায় এসব গান অত্যন্ত রস সমৃদ্ধ। পার্থিব জগৎ থেকে সরে গিয়ে পরম পুরুষের সন্ধানে অসীমলোকে যাত্রা করলেও কবি রূপ,রস,বর্ণ,ছন্দ দোলায় আন্দোলিত পৃথিবীকে বিস্মৃত হতে পারেন নি। বিধাতার বিচিত্ররূপ তিনি প্রকৃতির মাঝে উপলব্ধি করেছেন।অরূপকে লীলাময়রূপে পেয়েছেন শরৎ ঋতুর মাঝে—'আমার নয়ন–ভুলানো এলে। আমি কী হেরিলাম হৃদয় মেলে শিউলিতলার পাশে পাশে। ঝরাফুলের রাশে রাশে।
শিশির ভেজা ঘাসে ঘাসে
অরূণ রাঙা চরণ ফেলে
নয়ন–ভুলানো এলে। " (১৩নংগান)
শরতের বর্ণোজ্জ্বল উপস্থিতি কবির হৃদয়ে সংগীতের উৎসমুখ খুলে দিয়েছে। আনন্দে,গানে,সুরের ঝরনাধারায় তাঁর হৃদয় আজ কানায় কানায় পূর্ণ।এ কারণেই শারদলক্ষ্মীকে বরণের এমন বর্ণাঢ্য আয়োজন— "আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ,
আমরা গেঁথেছি শেফালি মালা।
নবীন ধানের মঞ্জুরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা।
এসোগো শারদ লক্ষ্মী তোমার
শুভ্র মেঘের রথে,
এসে নির্মল নীল পথে।" (১১নংগান)
সবশেষে আমরা রবীন্দ্র সংগীতালোচক শুভগুহ ঠাকুরতার কথায় বলব, "রবীন্দ্রনাথের মনকে মানবজীবন ও প্রকৃতি সমভাবেই প্রভাবিত করেছিল।রবীন্দ্র কাব্য ও রবীন্দ্র সংগীত এর সত্যতাই প্রমাণ করে... ঋতুচক্রের নানা আবর্তনে ধরিত্রীর নিত্য নবরূপ সবই চিত্রিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গানে।"
লেখক :
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ,
হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ, হবিগঞ্জ ।
গীতাঞ্জলিতে সাধনার ব্যাপ্তি, বেদনার অসীমতা, বিরহের ব্যাকুলতা বিচিত্র বর্ণচ্ছটায় দীপ্র। রবীন্দ্রনাথের অধ্যাত্মদৃষ্টি এই বিপুল বিশ্বের সবকিছুতেই অরূপ রতনের সুগভীর সুরমূর্ছনা শুনতে পেয়েছে। জীবন ও নিসর্গের বিচিত্র রূপের মধ্যে এক নিত্য অপরূপের লীলা বিভঙ্গ তাঁকে প্রতিনিয়ত অস্থির আকুল করে রেখেছে। যেন কিছুতেই দেবতার সান্নিধ্য লাভ হচ্ছে না। কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না পরম ভালোবাসার ধন। এ কারণে নিতল হাহাকারে গীতাঞ্জলির বহু গান অশ্রু-সজল। তিনি প্রকৃতির কবি বলে বারবার তাঁর অধ্যাত্মবোধের অবলম্বন হয়েছে প্রকৃতির বিচিত্র প্রকাশ। এ প্রসঙ্গে নীহাররঞ্জন রায় বলেন, "রবীন্দ্রনাথ জীবনের ও নিসর্গের সকল রূপের মধ্যে এক নিত্য অপরূপের লীলাই দেখিয়াছেন।সেই জন্যই তাঁহার অধ্যাত্ম মানসের আশ্রয় হইতেছে প্রকৃতির বিচিত্র প্রকাশ।"
অন্যান্য বিষয়ের সাথে তাঁর প্রকৃতি বিষয়ক সংগীত-বৈভব বাংলা কাব্যসংগীতকে নান্দনিকতায় অপূর্ব শ্রী দান করেছে। তাঁর মতো আর কোনো বাঙালি গীতিকার সংগীতকে অমিয় রসসিঞ্চনে এমন কান্ত মধুর করে তুলতে পারেন নি । এক্ষেত্রে তিনি বিস্ময়করভাবে অদ্বিতীয়। প্রকৃতির সঙ্গে নিতল সম্পর্কবোধেঋদ্ধ এসব গানকে রবীন্দ্র সমালোচক বলেছেন ঋতু সংগীত। মূলত প্রকৃতির সাথে সংগীতের সম্পর্ক অতি সুনিবিড়।
এ প্রসঙ্গে করুণাময় গোস্বামীর তথ্যসমৃদ্ধ বক্তব্যটি স্মরণযোগ্য, "প্রকৃতি যে মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী, মানুষের অনুভূতির অন্তহীন তরঙ্গমালাযে প্রকৃতির তরঙ্গের সাথে যুক্ত, সে কথা আমরা রবীন্দ্রনাথের গানে পাই। রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতির গানের সংখ্যা প্রায় ৩০০। গীতবিতানের প্রকৃতির গান পাওয়া যায় সংখ্যায় ২৮৩। শরৎ ঋতু নিয়ে কবির গান ৩০টি। তিনি শরতের শ্রেষ্ঠতম বাঙালি কবি। আনন্দ, বেরিয়ে পড়া, ছুটি এসবই হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের শরতের গানের মূলভাব।" এবার আমরা গীতাঞ্জলি কাব্যে শরৎ ঋতুর প্রতিফলন বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করব ।
ভগবৎ প্রেমে কবি যখন পরানসখা বন্ধুর সাথে মিলনের তৃষায় আকুল, তখনও শরতের সৌন্দর্য, মাধুর্যে তিনি বিমুগ্ধ। এসব গানে অধ্যাত্ম অনুভূতির ভাবতন্ময়তা ছাড়িয়ে প্রকৃতিপ্রীতিই দিব্যরাগে স্ফুট। রস ব্যঞ্জনায় অত্যন্ত গভীর এসব গানে ভাব-বৈভবেরসাথে চিত্র গরিমার স্নিগ্ধশ্রী বর্ণিল বিচিত্রতায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেছে। যেমন, "আজ ধানের খেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরি খেলা। নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা।--- ওরে যাবনা আজ ঘরেরে ভাই যাবনা আজ ঘরে! ওরে আকাশ ভেঙে বাহিরকে আজ নেবরে লুট করে।"(৮ নং গান)
জগৎ জীবন সম্পর্কে নিরাসক্ত কবি গীতাঞ্জলিতে যেখানে পরম দেবতার সন্ধানে তৎপর, যেখানে তিনি নিবেদনে কম্পিত, যেখানে বিরহের সকরুণ রাগিণী নিরন্তর বেজে চলেছে সেই গীতাঞ্জলিতেই আবার ভিন্ন ব্যঞ্জনা। এখানে বেজে উঠে আনন্দের বাঁশি। সুখের অমল সংগীত।
এখানে যেন ভাবতন্ময়তা ছেড়ে কবি -মন আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠেছে–" শরতে আজ কোন অতিথি এল প্রাণের দ্বারে
আনন্দ গান গারে হৃদয়
আনন্দ গান গা রে।"(৩৮নং গান)
গীতাঞ্জলির অনেক গানে নিসর্গানুভূতি উজ্জ্বলরূপে বিকশিত এ কথা বলাই বাহুল্য।ঈশ্বর চেতনা এখানে প্রচ্ছন্ন। এ কারণে ভাবতন্ময়তায় এসব গান অত্যন্ত রস সমৃদ্ধ। পার্থিব জগৎ থেকে সরে গিয়ে পরম পুরুষের সন্ধানে অসীমলোকে যাত্রা করলেও কবি রূপ,রস,বর্ণ,ছন্দ দোলায় আন্দোলিত পৃথিবীকে বিস্মৃত হতে পারেন নি। বিধাতার বিচিত্ররূপ তিনি প্রকৃতির মাঝে উপলব্ধি করেছেন।অরূপকে লীলাময়রূপে পেয়েছেন শরৎ ঋতুর মাঝে—'আমার নয়ন–ভুলানো এলে। আমি কী হেরিলাম হৃদয় মেলে শিউলিতলার পাশে পাশে। ঝরাফুলের রাশে রাশে।
শিশির ভেজা ঘাসে ঘাসে
অরূণ রাঙা চরণ ফেলে
নয়ন–ভুলানো এলে। " (১৩নংগান)
শরতের বর্ণোজ্জ্বল উপস্থিতি কবির হৃদয়ে সংগীতের উৎসমুখ খুলে দিয়েছে। আনন্দে,গানে,সুরের ঝরনাধারায় তাঁর হৃদয় আজ কানায় কানায় পূর্ণ।এ কারণেই শারদলক্ষ্মীকে বরণের এমন বর্ণাঢ্য আয়োজন— "আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ,
আমরা গেঁথেছি শেফালি মালা।
নবীন ধানের মঞ্জুরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা।
এসোগো শারদ লক্ষ্মী তোমার
শুভ্র মেঘের রথে,
এসে নির্মল নীল পথে।" (১১নংগান)
সবশেষে আমরা রবীন্দ্র সংগীতালোচক শুভগুহ ঠাকুরতার কথায় বলব, "রবীন্দ্রনাথের মনকে মানবজীবন ও প্রকৃতি সমভাবেই প্রভাবিত করেছিল।রবীন্দ্র কাব্য ও রবীন্দ্র সংগীত এর সত্যতাই প্রমাণ করে... ঋতুচক্রের নানা আবর্তনে ধরিত্রীর নিত্য নবরূপ সবই চিত্রিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গানে।"
লেখক :
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ,
হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ, হবিগঞ্জ ।