স্বপ্না চক্রবর্তী : সংগ্রামের পথ পেরিয়ে সাফল্যের শিখরে

আপলোড সময় : ২২-০৯-২০২৫ ০১:০১:১৫ পূর্বাহ্ন , আপডেট সময় : ২২-০৯-২০২৫ ০১:০১:১৫ পূর্বাহ্ন
স্বপ্না চক্রবর্তী- লক্ষ্য ছিল অবিচল, স্বভাব ছিল প্রচণ্ড জেদি, আর অন্তরে ছিল অসীম সাহস। এই তিনের অপূর্ব মিশ্রণে সে জয় করেছে কঠিনতম পথ, পৌঁছে গেছে চূড়ান্ত গন্তব্যে। সে কেবল একজন সফল যাত্রী নন, সে এক সত্যিকারের যোদ্ধা। হবিগঞ্জের এই কৃতী সন্তান তার সংগ্রাম, অধ্যবসায় এবং সাহসিকতার মাধ্যমে প্রমাণ করেছে, প্রতিকূলতা যতই ভয়ানক হোক, দৃঢ় মনোবল থাকলে লক্ষ্য কখনো হারায় না।
সালটি ছিল ২০০৩। একদিন আমার দৈনিক হবিগঞ্জ এক্সপ্রেস অফিসে এসে দেখা করল স্বপ্না। তখনো সে স্কুলছাত্রী। মৃদু হাসি আর উচ্ছ্বাস নিয়ে জানালো সে লেখালেখিতে আগ্রহী। ইতিমধ্যেই অনেক গল্প ও কবিতা লিখেছে। শুধু তাই নয়, সাংবাদিকতায়ও তার প্রবল আগ্রহ। আমি তাকে সে অনুমতি দিলাম। এরপর থেকে সুযোগ পেলেই সে অফিসে আসত। কাজ করত, লিখত, আর প্রতিদিন নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করত। কম্পিউটারের কীবোর্ডে তার আঙুল নাচত অবিশ্বাস্য গতিতে। শুধু শোনা যেত টকটক শব্দ। এত দ্রুত সে কম্পোজ করত যে, আমি বিস্মিত না হয়ে পারতাম না। মনে হতো, যেন তার প্রতিটি শব্দ আগেই মস্তিষ্কে খোদাই করা আছে, আর কেবল আঙুলের ছোঁয়ায় সেগুলো ঝরে পড়ছে কীবোর্ডে। সেই সময়ের দিন গুলোতে সাহসী কন্যা স্বপ্না নিজের আত্মরক্ষার জন্য ভ্যানেটি ব্যাগে সব সময় ছুরি রাখতো। যেন প্রয়োজনে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। 
হঠাৎ করেই একদিন মারা যান স্বপ্নার বাবা। পরিবারের ভার যেন আচমকাই এসে পড়ল তার কাঁধে। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সে-ই ছিল সবার বড়। শুরু হলো তার প্রকৃত জীবনযুদ্ধ। অল্প বয়সেই সংসার চালানোর সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হলো তাকে। পাশে দাঁড়ালেন তার মা। সে শুরু করলো টিউশনি। পাশাপাশি আমাদের হবিগঞ্জ এক্সপ্রেসে 
চাকরি। কখনো দিন গুজরানের জন্য, কখনো নিজের স্বপ্ন আর ভাইবোনদের পড়াশোনা টিকিয়ে রাখার জন্য টিউশনি চালিয়েই যেতে হলো তার। তবু অভাব যেন কোনোভাবেই গুছছিল না; সংসারের ভার প্রতিদিনই আরও ভারী হয়ে উঠছিল। কখনো টিউশনের বেতন, কখনো আবার পড়াশোনার ফি—সব জায়গাতেই টানাপোড়েন লেগেই থাকত।  এই সবকিছুই স্বপ্না আমাকে খোলাখুলিভাবে শেয়ার করত। সেই দুঃসময়ে আমি আমার সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্যের চেষ্টা করেছি। কারণ, আমার এখানে সে যতটুকুই কাজ করেছে, সবই করেছে অবৈতনিকভাবে, শুধুই আগ্রহ আর স্বপ্নের টানে। 
স্বপ্নার কাজকে আমার অফিসের দু-একজন কখনোই ভালো চোখে দেখত না। হয়তো তার বয়স, হয়তো তার অনবরত কাজ করার একাগ্রতা সব মিলিয়ে তাদের মনে একধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া জন্ম নিয়েছিল। সরাসরি কিছু না বললেও, তাদের চোখের ভাষা আর আচরণ থেকে আমি তা সহজেই বুঝতে পারতাম। তবুও আশ্চর্যের বিষয়, স্বপ্না এসবকে কোনো গুরুত্বই দিত না। মাথা নিচু করে নিজের কাজে মন দিত, যেন চারপাশের বিরূপতা তার কাছে একেবারেই তুচ্ছ। সেই ছোট্ট বয়সেই তার মধ্যে যে ধৈর্য, সহনশীলতা আর লক্ষ্যপানে অবিচল থাকার ক্ষমতা ছিল তা আমাকে মুগ্ধ করত। মনে হতো, প্রতিকূলতার মধ্যেই সে যেন আরও শক্ত হয়ে ওঠে। স্বপ্না আমাকে শুধু একজন কাকু নয়, বরং পিতৃতুল্য ভাবত। তার বিশ্বাস, স্নেহ এবং ভরসা ছিল নিখাদ। এমনকি পিতা-কন্যার সম্পর্ককেও স্বপ্না শত নেতিবাচকতার কাছে মাথা নিচু করেনি; সে বিশ্বাস, অধ্যবসায় এবং সততার সঙ্গে নিজের পথচলা অব্যাহত রেখেছে।
এক সময় স্বপ্না তার শিক্ষা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অতিক্রম করল- এসএসসি এবং পরে এইচএসসি পাশ করল। তার একটাই লক্ষ্য ছিল নিজে ও ভাই বোনকে প্রতিষ্ঠিত করা। তাদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করা—এসবই তার অগ্রাধিকার। আর নিজের জীবন?  সেটি তার চিন্তার বাইরে ছিল, কারণ তার মন সবসময় ভাই বোনদের ভবিষ্যৎ ও পরিবারের কল্যাণে স্থির থাকত। সেই স্বপ্ন পূরণের জন্যই ব্যাচেলরের পড়াশোনার উদ্দেশ্যে তাকে সিলেটে চলে যেতে হলো। বিদায় নেওয়ার দিন, স্বাভাবিকভাবেই সে অফিসে এসে সবার সাথে সাক্ষাৎ করল। বিদায় বেলায় প্রণাম করে বলেছিল কাকু, এই কন্যাকে কন্যাদান আপনাকেই করতে হবে। 
সিলেটে গিয়ে স্বপ্না নতুন জীবন শুরু করল। ব্যাচেলরের পড়াশোনার পাশাপাশি লেখালেখি ও সাংবাদিকতায় তার আগ্রহ কমেনি। নতুন শহরে, নতুন পরিবেশে সবকিছুই সহজ ছিল না। তবে তার দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি আর কঠোর পরিশ্রম তাকে প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করতে সাহায্য করত। টাকার অভাবে প্রতিদিন সে কত শত পথ হেটেছে, সে হয়তো নিজেও  জানেনা। কলেজ, অফিস, টিউশনি সকল স্থলে তার যাতায়াতের একমাত্র সম্বল ছিল পা। এই কষ্ট গুলো কখনোই তার কাছে কষ্ট বলে মনে হয়নি। বরং সব সময় সে হাসিমুখে এগিয়ে গেছে, কষ্টকে সাহস ও অধ্যবসায়ের সঙ্গে বরণ করেছে। টিউশনি চালিয়ে নিজের এবং ভাইবোনের পড়াশোনা সামলানো, সঙ্গে সিলেটের পত্র-পত্রিকায় সাংবাদিকতার কাজ করা সবকিছুকেই সে সম্পূর্ণ আত্মত্যাগ এবং নিষ্ঠার সঙ্গে করে গেছে। সিলেটে অবস্থানকালে স্বপ্না প্রায়ই ফোনে যোগাযোগ রাখতো। দিনের ফিরিস্তি দিতো। 
অনার্স সম্পন্ন করে, সাহসী ও আত্মনিষ্ঠ যোদ্ধা স্বপ্না তার পরবর্তী যাত্রার জন্য রাজধানী ঢাকা পৌঁছাল। দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকার মাধ্যমে শুরু করলো জাতীয় পর্যায়ের সাংবাদিকতার পথ শুরু। এরই মধ্যে নিজে বিয়ে না করে ছোট বোনকে বিয়ে দিল এবং ভাইকে প্রতিষ্ঠিত করলো। আমি দেশে থাকতেই স্বপ্না আমাকে তার পছন্দের ছেলের কথা জানিয়েছিল। তার বরকে অনেক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে, কারণ স্বপ্নার পণ ছিল—বোনকে বিয়ে দিয়েই সে নিজে বিয়ের পিড়িতে বসবে। দীর্ঘ প্রবাস জীবনে স্বপ্নার সঙ্গে আমার যোগাযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। এক বছর বিজয়ার প্রণাম  জানিয়েছে, আর ৩–৪ বার ম্যাসেজ করেছে কাকু কেমন আছেন জানতে; কোনটির উত্তর দিয়েছি, কোনটির দেইনি। দীর্ঘ প্রবাস জীবনে ফোনে তার সঙ্গে কথা হয়েছে সব মিলিয়ে দুই থেকে তিন দিন। বিয়ের এক মাস আগে স্বপ্না ফোন করে নিমন্ত্রণ জানায় এবং দেশে গিয়ে তাকে পাত্রস্থ করার অনুরোধ করে। তবে প্রবাস জীবনের নানা সীমাবদ্ধতার কারণে আমি অপারগতা প্রকাশ করি। স্বপ্নার সব স্বপ্ন পূরণ হলেও এই একটিমাত্র স্বপ্ন তার অধরাই থেকে গেল।
গত বৃহষ্পতিবার দিবাগত রাত ২টার দিকে হঠাৎ করেই স্বপ্না ফোন করে। ব্যস্ত থাকায় রিসেভ করতে পারিনি। প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে আমি তাকে ফোন করি। প্রথমেই বললাম আমাদের সেই স্বপ্না আজ এত বড় সাংবাদিক ভাবতেই অবাক লাগে। সে বললো কাকু ১৫ বছর বয়সে আপনার দরজায় দাড়িয়েছিলাম, আর আজ যেখানে এসে দাড়িয়েছি সে তো শুধুমাত্র আপনার জন্যই। এরপর সে উল্লেখ করল, ‘এই তো কয়েকদিন আগে আমার সম্পাদক করিম ভাইয়ের সঙ্গে আপনাকে নিয়ে কথা হচ্ছিল। তিনি আপনাকে চেনেন ও জানেন।’ স্বপ্না আজ রাজধানী ঢাকার প্রতিষ্ঠিত জাতীয় সাংবাদিক। বর্তমানে সে রূপালী বাংলাদেশের সিনিয়র রিপোর্টার। এর আগে সে জনকণ্ঠ এবং ভোরের কাগজে কাজ করেছে। 
প্রতিটি কষ্টের দিন, প্রতিটি অব্যাহত পরিশ্রম সব মিলিয়ে তাকে গড়ে তুলছে এক সাহসী, অভিজ্ঞ ও স্বাবলম্বী নারী হিসেবে। স্বপ্না চক্রবর্তী প্রমাণ করেছে, জীবনের প্রতিকূলতা যতই কঠিন হোক, অধ্যবসায়, সততা এবং দৃঢ় মনোবল থাকলে লক্ষ্য কখনো হারায় না। সে কেবল একজন সফল সাংবাদিক নন, সে একজন অনন্য যোদ্ধা, যে নিজের সাহস, অধ্যবসায় এবং দায়িত্ববোধের মাধ্যমে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে। মেয়েটির জন্য রইল অগাধ ভালোবাসা আর অনন্ত শুভকামনা।

সম্পাদকীয় :

চিনু মৃধা : সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি

সম্পাদক ও প্রকাশক : চিন্ময় আচার্য্য, নির্বাহী সম্পাদক : কামাল মোস্তফা, সহযোগী সম্পাদক : আশিক রহমান,

বার্তা সম্পাদক : তোফায়েল রেজা সোহেল, ফিচার এডিটর : সৈয়দ আসাদুজ্জামান সোহান, স্টাফ রিপোর্টার : মৃদুল কান্তি সরকার।

অফিস :

22021 Memphis Ave Warren, MI 48091

Phone : +1 (313) 312-7006

Email : [email protected]

Website : www.suprobhatmichigan.com