সিলেট, ৯ ফেব্রুয়ারি : আওয়ামী লীগ আমলে ২০১০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র উন্নয়ন বাজেটে ৭ হাজার লক্ষ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. এ কে এনামুল হক ।
শনিবার সিলেটের শত বছরের সাংবাদিকতার স্মারক প্রতিষ্ঠান সিলেট প্রেসক্লাবের উদ্যোগে সংস্কার, জাতীয় ঐক্য ও ভাবনা বিষয়ক নাগরিক সংলাপে তিনি এ মন্তব্য করেন। নগরীর রিকাবিবাজারস্থ কবি নজরুল অডিটোরিয়ামে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে তিনি আরো বলেন, ২০১০ থেকে ২০২৩-২৪ সেশনে উন্নয়ন বাজেটে খরচ হয়েছে ১৭ লক্ষ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭ হাজার লক্ষ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। এই টাকা কোথাও না কোথাও তো গেছে। এই টাকা শুধু রাজনীতিবিদের কাছেই যায়নি ; সরকারি আমলাদের ভাগ আরো বেশী। এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, আগে মানুষ টেবিলের নিচ নিয়ে ঘুষ নিতো। কিন্তু, গত ১৫ বছরে ঘুষের জন্য টেবিল সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
সিলেট প্রেসক্লাব সভাপতি ইকরামুল কবিরের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলামের সঞ্চালনায় এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন- শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদেও সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. কামাল আহমদ চৌধুরী।
নাগরিক সংলাপে অংশ নেন- সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী, মহানগর জামায়াতের আমীর মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম, সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম শাহীন, লিডিং ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. বশির আহমদ ভূঁইয়া, সিলেট প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ইকবাল সিদ্দিকী, সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ফয়েজ হাসান ফেরদৌস, ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহমুদুল হাসান, সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ফয়েজ আহমদ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক দেলোয়ার হোসেন শিশির, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষক জোটের সমন্বয়ক অধ্যাপক ফরিদ আহমদ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শহীদ মোস্তাক আহমদের ভাই সোহেল আহমদ, উইমেন ফর ইউমেন রাইটসের সভাপতি সামিয়া বেগম চৌধুরী, সিলেট প্রেসবিটারিয়ান চার্চের ইন্সটিটিউটের ডিকন নিঝুম সাংমা, ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমি সিলেটের উপ-পরিচালক শাহ মো. নজরুল ইসলাম প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি আরো বলেন, দেশের শিক্ষা নিয়ে কথা বললে, নকল করা নিয়ে ঐক্যমত্য আছে কি না আমি সন্দেহ করি। কারণ বাবা পরীক্ষার প্রশ্ন কিনে নিয়ে এসে ছেলেকে দেয়। এটা আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থা। এমন অবস্থায় কি করবেন? তিনি বলেন, আমরা শ্বেতপত্র কমিটিতে যখন কাজ করলাম, তখন অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমি কাজ করার সময় এমন কোনো ব্যক্তিকে পাইনি যিনি বলেছেন দুর্নীতির জন্য আমি দায়ী। সবাই শুধু বলে উপরের লোকজন দায়ী। সুতরাং কেউ নিজেকে দায়ী করতে রাজী না। ভালো ভোট হলেও দেশের ভালো হবে না, দেশ অগ্রসর হবে না। ভালো ভোটের পরও দেশের অবস্থা খারাপ হয়েছে। এজন্য দীর্ঘ সময় নিয়ে সংস্কার করতে হবে। শর্ট টাইম নিয়ে সংস্কার করতে পারবেন না। ভালোভাবে সংস্কার করতে হবে।
অধ্যাপক এ কে এনামুল হক আরো বলেন, সংস্কার বিষয়ে সবাই সবজায়গায় একমত নাও হতে পারি। তবে, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হ লে কিছু বিষয়ে সবার মধ্যে মিনিমাম ঐক্যমত্য প্রয়োজন।
তিনি আরো বলেন, দেশ প্রেমকে প্রথমে নিজের করতে হবে। কারণ আমাদের অনেকের মধ্যে দেশ প্রেমের চেয়ে নিজের প্রেম, গোষ্ঠী প্রেম অনেক বেশি। আমরা রাজনৈতিকভাবে যে যে দলের ভক্ত, সেই বিষয়ে প্রাধান্য দিচ্ছি দেশকে পিছনে ফেলে। অন্তবর্তী সরকার ক্ষমতা বেশিদিন হয়নি, ৬ মাস হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে ১৫০ টিরও বেশি আন্দোলন হয়েছে। তার মানে বুঝতে পারছেন সবাই সবারটা নিয়ে ব্যস্ত, সবাই ভাবছে এই হচ্ছে একমাত্র সুযোগ। এই যে চিন্তা ভাবনা এটা থেকেই এতসব আন্দোলন। এই আন্দোলন কমছে না, বরং বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। সংস্কারের দায়িত্ব শুধু ইউনূস সরকারকে নিলে হবে না। প্রত্যেকেই নিজেদের সংস্কারের দায়িত্ব নিতে হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক ড. কামাল আহমদ চৌধুরী বলেন, গত কয়েক বছরে দেশের রাজনৈতিক ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক কাঠামো ধ্বংস করা হয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যূত্থানের পর অন্তর্র্বতী সরকার ক্ষমতায় এসেছে। পরবর্তীতে রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে গঠিত হয়েছে সংস্কার কমিশন।
অন্য বক্তারা বলেন, প্রথমত প্রয়োজন ছিল শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি নিয়ে কোনো কমিশন গঠিত হয়নি। এখন গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে আর পড়ালেখা হয় না। এটা নিয়ে ভাবা দরকার। কেননা এই প্রাইমারি থেকেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা শুরু হয়। শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে, বিচারব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে। আগে এগুলোর সংস্কার করতে হবে এবং এগুলোর জন্য আইন প্রণয়ন করতে হবে। বক্তারা বলেন, সংস্কারের জন্য সবকিছু আটকে থাকতে পারে না। সংস্কার চলবে, সাথে অন্যান্য বিষয়ও চলুক। এছাড়া প্রথম সংস্কারটা দরকার ব্যক্তিমানুষের। মানুষের মধ্যে যদি নৈতিকতা না আসে, তাহলে সবকিছু পূর্বের ন্যায় থেকে যাবে। আইন কখনোই নিজের হাতে তোলে নেওয়া যাবে না। সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন বক্তারা ।
সিলেটের প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় লিডিং ইউনিভার্সিটি ও দি সিলেট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সহযোগিতায় আয়োজিত সংলাপের শুরুতেই ছাত্র-জনতার অভূত্থানে পুলিশের গুলিতে নিহত সিলেট প্রেসক্লাবের সদস্য শহীদ এটিএম তুরাবের রুহের মাগফেরাত কামনা করা হয়।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Suprobhat Michigan