আমেরিকা , রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ , ১১ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
বনশ্রীতে ব্যবসায়ীকে গুলি করে ২০০ ভরি স্বর্ণ লুট ধানমন্ডিতে সশস্ত্র মহড়া, ডাকাত আতঙ্কে মসজিদে মাইকিং ডিয়ারবর্নে রোড রেজের জেরে নারী চালককে গুলি করে হত্যা দুর্ঘটনা : ওয়েইন কাউন্টির স্লেজিং হিল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে মিশিগানের সর্বকালের তুষারপাতের  রেকর্ডের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ক্যান্টন এবং ওয়েইনে পুলিশের অভিযান : মেথসহ ১ জন গ্রেফতার  ডেট্রয়েট ২ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ২৫টিরও বেশি গাড়ি চুরির অভিযোগ  ঝিনাইদহে শীর্ষ চরমপন্থি নেতা হানিফসহ ৩ জনকে গুলি করে হত্যা ক্লিনটনে ডোনাট স্টোরের কর্মীর গুলিতে এক সশস্ত্র ডাকাত নিহত ম্যাকম্ব টাউনশিপে গ্যাস স্টেশনে ডাকাতি, ৫ জন গ্রেফতার গৌরব-প্রেরণার একুশ আজ জেনেসি কাউন্টির ডেপুটি বরখাস্ত হ্যাজেল পার্কে ইন্টারস্টেট ৭৫-এ দুর্ঘটনায় টেক্সাসের এক নারী নিহত বিক্ষোভের মধ্যেই ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানালেন রাষ্ট্রপতি নোয়াখালীতে মাজারে হামলা-ভাঙচুর  মধ্যরাতে ঢাকায় যৌথবাহিনীর সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত ২ সাউথফিল্ড হোটেলে কিশোর হত্যার তদন্ত থমকে গেল মিশিগানে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন ড. শাহীন হাসান সাউথফিল্ড ফ্রিওয়েতে রোলওভার দুর্ঘটনায় চালকের মৃত্যু করের অর্থে ট্রাম্পের অভিষেকে যোগ দেন হ্যামট্রাম্যাকের মেয়র ও তিন কাউন্সিলম্যান

একুশে পদকপ্রাপ্ত বরেণ্য বৌদ্ধ ভিক্ষু বিশুদ্ধানন্দ মহাথের'র কর্ম ও জীবন 

  • আপলোড সময় : ২৩-০২-২০২৫ ০২:৩৩:২৩ অপরাহ্ন
  • আপডেট সময় : ২৩-০২-২০২৫ ০২:৩৩:২৩ অপরাহ্ন
একুশে পদকপ্রাপ্ত বরেণ্য বৌদ্ধ ভিক্ষু বিশুদ্ধানন্দ মহাথের'র কর্ম ও জীবন 
চট্টগ্রাম, ২৩ ফেব্রুয়ারী : মহামান্য মহাসংঘনায়ক শ্রীসদ্ধর্মভাণক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের নামটি বাঙ্গালি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নিকট উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক সদৃশ। বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্ম ও সম্প্রদায়ের যে পরিচয় তার সঙ্গে নীতিগত ভাবে মহাসংঘনায়ক শ্রীসদ্ধর্মভাণক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের (বড়ভান্তে) এর নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয়। কেননা তিনি শত প্রতিকূলতার মাঝেও সমাজ, সদ্ধর্ম ও মানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে গিয়েছেন। বাংলাদেশের অবহেলিত পশ্চাৎপদ বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীকে আত্মপ্রত্যয়ে স্বনির্ভর হওয়ার মন্ত্রদাতা হিসাবে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য সাধারণ। মহামান্য মহাসংঘনায়ক অন্যান্য সম্প্রদায়ের তুলনায় প্রায় সকল ক্ষেত্রে বাংলার বৌদ্ধ সমাজের অনগ্রসরতা উপলব্ধি করে সমাজকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে এগিয়ে নেওয়ার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হয়ে অবিরাম জীবন সংগ্রামে রত থেকে দেশ, সমাজ ও সদ্ধর্মের সেবা করেছেন। বুদ্ধের অহিংসা মন্ত্র অন্তরে ধারণ করে তাঁর ৮৬ বছর পরমায়ু দীপ্ত জীবন বহুজনের হিতে বহুজনের সুখে নিবেদিত। তাঁর জীবনের মহান বৈশিষ্ট্য গুলি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। 

মহান মানবপ্রেমিক নিষ্ঠাবান দেশপ্রেমিক, লব্ধপ্রতিষ্ঠ সমাজ হিতৈষী, দুঃস্থ ও অবহেলিত জনগোষ্ঠীর ঠিকানা, মানবতার মূর্তপ্রতীক মহাত্মা কর্মযোগী মহামান্য মহাসংঘনায়ক শ্রীসদ্ধর্মভাণক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৩১৫ বঙ্গাব্দ, ঊষালগ্নে চট্রগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলাধীন পূর্বগুজরাস্থ হোয়ারাপাড়া গ্রামে পিতা- কর্মধন বড়ুয়া ও মাতা- চিন্তাবতী বড়ুয়া'র কোল আলো করে শুভ মাহেন্দ্রক্ষণে জন্মগ্রহণ করেন থালেশ্বর বংশধারার একবিংশতম প্রতিনিধি। নাম রাখা হয় শশাংক বড়ুয়া। শশাংক শৈশব থেকেই পিতৃব্য সংঘনায়ক সৌগতসূর্য অগ্রসার মহাস্থবিরের প্রত্যক্ষ সাহচর্য লাভ করেন, কেননা তিনি শৈশবেই পিতৃহারা হন। অগ্রসার মহাস্থবিরের সাধন ভূমি সুদর্শন বিহার ও বিহার কেন্দ্রিক প্রাথমিক বিদ্যালয় তাঁদের বাড়ির পাশে হওয়ায় শশাংকের আসা-যাওয়া ছিল এই বিহারে এবং সেখানেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি। শৈশব উত্তীর্ণ হয়ে কৈশোরে পা দিতেই অর্থাৎ উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন কালীন তিনি মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বাধীন বৃটিশ বিরোধী ও দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দলভূক্ত হন। বস্তুত তখন থেকেই তাঁর উজ্জ্বল দেশপ্রেম বোধের শুভ সুচনা হয়ে যায়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে  বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়। 

১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে পিতৃব্য সংঘনায়ক অগ্রসার মহাস্থবির শশাংককে ১৬ বছর বয়সে শ্রামণ্য ধর্মে দীক্ষা দান করেন, নাম রাখেন শ্রী বিশুদ্ধানন্দ। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে পিতৃব্য গুরু অগ্রসার মহাস্থবিরের উপাধ্যায়ত্বে উপসম্পদা প্রদান করা হয়, পরিচিতি পায় বিশুদ্ধানন্দ ভিক্ষু হিসাবে। তিনি প্রথম বর্ষাবাস যাপন করেন পটিয়া উপজেলার পাঁচরিয়া গ্রামের একটি বিহারে। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে পিতৃব্য গুরু অগ্রসার মহাস্থবির ভারতের সারনাথ মূলগন্ধ কুঠি বিহারের দ্বারোদঘাটন ও বুদ্ধের দেহভষ্ম গ্রহণ কালে সাথে ছিলেন। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি উচ্চতর ধর্মীয় শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে শ্রীলঙ্কার বিদ্যালঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। দুই বছর অধ্যয়ন শেষে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ উপাধি "শ্রীসদ্ধর্মভাণক" উপাধিতে ভূষিত হন। শ্রীমৎ বিশুদ্ধানন্দ ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফিরে সমাজ, সদ্ধর্ম ও মানবতার সেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম জনপদে গুরুদেব সৌগতসূর্য অগ্রসার মহাস্থবিরের ৭৫তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বৌদ্ধ মহাসম্মেলন ও পরিবাসব্রত অনুষ্ঠানে তাঁর ভূমিকা এখনো সমুজ্জ্বল এবং ইতিহাসের অংশ হয়ে রইল। 

১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর পটভূমিকায় ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে দুঃস্থ, নিরন্ন ও ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর দীপ্ত সংকল্প ও গুরুদেবের স্মৃতির নিদর্শন স্বরুপ তিনি প্রতিষ্ঠা করেন "অগ্রসার মেমোরিয়াল সোসাইটি" যা কালক্রমে বিশাল কল্যাণকর মহাকমপ্লেক্সে পরিণত হয়। উল্লেখ্য পিতৃব্য গুরুদেব সৌগতসূর্য অগ্রসার মহাস্থবির ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে মহাপ্রয়াণ করেন। তিনি তাঁর সুযোগ্য শিষ্য অনাথপিতা উপসংঘনায়ক সুগতানন্দ মহাথেরকে সাথে নিয়ে অগ্রসার মেমোরিয়াল সোসাইটিকে প্রসারিত করেন বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায়, যেমন ১. অগ্রসার বৌদ্ধ অনাথালয়, ২. অগ্রসার শিক্ষা প্রকল্পের  অধীনে অগ্রসার পালি কলেজ, অগ্রসার পালি ও সংস্কৃতি পরীক্ষা কেন্দ্র, অগ্রসার বৌদ্ধ অনাথালয় উচ্চ বিদ্যালয়, অগ্রসার টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার, অগ্রসার বালিকা মহাবিদ্যালয় ৩. অগ্রসার ত্রাণ ও পূণর্বাসন প্রকল্প  ৪. অগ্রসার প্রেমানন্দ লাইব্রেরী ৫. অগ্রসার প্রিন্টিং প্রেস ৬. অগ্রসার বৌদ্ধ ধর্মচর্চা, গবেষণা ও প্রকাশনা ৭. অগ্রসার যাতায়াত ও যোগাযোগ প্রকল্প ৮. অগ্রসার শিল্পালয়ের আওতায় বর্তমান জাপানের সহায়তায় সেইসা সীগাল গার্মেন্টস নামে আন্তর্জাতিক মানের গার্মেন্টস ৯. অগ্রসার আত্মকর্মসংস্থান ও ঋণদান প্রকল্প ১০. অগ্রসার চিকিৎসা প্রকল্পের আওতায় বর্তমানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে অগ্রসার হেল্থ কেয়ার নামে একটি আধুনিক হাসপাতাল। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে অগ্রসার মেমোরিয়াল সোসাইটি "বিশ্ব বৌদ্ধ সৌভ্রাতৃত্ব সংঘ" (WFB) এর বাংলাদেশের আঞ্চলিক কেন্দ্রের স্বীকৃতি লাভ করেন। 

 ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশ বিভাগের পর সাম্প্রদায়িক হানাহানি দেখা দিলে তারুণ্য দীপ্ত বিশুদ্ধানন্দ ভিক্ষু বৌদ্ধ সমাজকে অগ্রসরমান করতে নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রবীণ ভিক্ষু-সংঘ ও বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন প্রতিষ্ঠার লক্ষে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকেন। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন পূর্বপাকিস্তান বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ। শ্রীমৎ বিশুদ্ধানন্দ ভিক্ষু সভাপতি ও বঙ্গিশ বড়ুয়া (বঙ্গিশ ভিক্ষু) সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন, স্বাধীনতা পরবর্তী তা বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ নাম ধারণ করে, বিশুদ্ধানন্দ মহাথের সংঘের আমৃত্যু সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ২৯টি দেশের প্রতিনিধি নিয়ে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব বৌদ্ধ সম্মেলনে পাকিস্তানি বৌদ্ধদের সরকারি প্রতিনিধি দল যোগদান করেন বিশুদ্ধানন্দ ভিক্ষুর নেতৃত্বে। এ সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে "বিশ্ব বৌদ্ধ সৌভ্রাতৃত্ব সংঘ" গঠিত হয়। শ্রীমৎ বিশুদ্ধানন্দ ভিক্ষু বিশ্ব বৌদ্ধ সৌভ্রাতৃত্ব সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও পরবর্তীতে মানবাধিকার শাখার সভাপতি মনোনীত হন। 

১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে তিনি তৎকালীন সরকার কতৃক চিকিৎসা বিজ্ঞান শাস্ত্রে ভর্তি ছাত্র-ছাত্রীদের নির্বাচনী কমিটির সদস্য মনোনীত হন। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর সহায়তায় বাঙালি বৌদ্ধ মহাপণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের মুন্সিগঞ্জের বজ্রযোগিনীতে অবস্থিত বাস্তুভিটা চিহ্নিত করেন। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে এদেশের বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রাচীনতম সংগঠন বৌদ্ধ ভিক্ষু মহাসভা তাঁকে মহাথের অভিধায় অভিষিক্ত করেন, নাম হলো বিশুদ্ধানন্দ মহাথের, বিদেশে "মহাথের" এবং দেশে "বড়ভান্তে" নামে সমধিক পরিচিত হন। বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সম্পৃক্ত করার মানসে ঢাকায় একটি বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠার লক্ষে দীর্ঘ ১০ বছর অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা, সরকারের সাথে দেন-দরবার ও যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যমে কমলাপুরে সারে চার একর জায়গা বরাদ্দ পান এবং ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন ধর্মরাজিক বিহার। যার অধিনে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রিয় শিষ্য সংঘনায়ক শুদ্ধানন্দ মহাথেরকে সাথে নিয়ে ধর্মরাজিক অনাথালয়, পর্যায়ক্রমে ধর্মরাজিক উচ্চ বিদ্যালয় সহ বহু জনহিতকর প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। যা আন্তর্জাতিক ভাবে ধর্মরাজিক মহাকমপ্লেক্স নামে প্রতিষ্টিত। মাননীয় মহাথেরকে সমাজ সেবা ও আন্তঃধর্মীয় কর্মকান্ডের স্বীকৃতি স্বরূপ তৎকালীন সরকার ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে "তঘমা ই খেদমত" ও ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে "তঘমা ই পাকিস্তান" উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে রাণী এলিজাবেথ অভ্যর্থনা কমিটির সদস্য, ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে সরকারি প্রতিনিধি হয়ে চীন সফর কালে চীন সরকারকে বাংলার গৌরব অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের দেহভষ্ম প্রদানের অনুরোধ করেন। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে দেহভষ্ম লাভ এবং ধর্মরাজিক মহাবিহারে প্রতিষ্ঠা করেন। 

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিকামী জনসাধারণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রসার ও ধর্মরাজিকে আশ্রয়সহ নানা ভাবে সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি অনন্য ভূমিকা পালন করেন। তাঁর আন্তর্জাতিক তৎপরতায় পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রতি নমনীয় ভাব পোষণ করতে বাধ্য করেন এবং তাঁর প্রদত্ত পরিচয় পত্র নিয়ে যে-কেউ অবাদ চলাফেরার সুযোগ পান। যা পাকিস্তানি সামরিক জান্তার কাছে "মহাথের ডান্ডি কার্ড" নামে পরিচিত ছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামে পাক-হানাদার বাহিনীর নৃশংস বর্বরতা ও হত্যাযজ্ঞের চিত্র ও স্বাধীনতার পটভূমিকা সম্বলিত তাঁর লেখা "রক্ত ঝড়া দিনগুলো" বইটি ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন বাংলার স্থপতি, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সাথে সাক্ষাৎ পূর্বক প্রদান করলে বঙ্গবন্ধু মহাথের'র ভূয়সী প্রশংসা করেন। 
১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর চাহিদা ও ধর্মচর্চার প্রয়োজনে কাতালগঞ্জে একটি বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। ভবিষ্যত প্রজন্মের স্মৃতিতে দশম শতকের "পণ্ডিত বিহার" কে সমুজ্জ্বল রাখতে নাম রাখেন "নব পণ্ডিত বিহার"। 
১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকায় বিশ্ব ধর্ম শান্তি সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করে মানবাধিকার বিষয়ক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। ঐ বছর তাঁকে বাংলাদেশ বৌদ্ধ ভিক্ষু মহাসভা সংঘনায়ক মনোনীত করেন এবং পরবর্তীতে তাঁর কর্মদক্ষতা তাঁকে মহাসংঘনায়কের আসনে প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ধর্মরাজিকের অধীনে অতীশ দীপঙ্কর স্মৃতি সৌধের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন এবং মহাথেরকে দেশের একজন বেসরকারি রাষ্ট্রদূত হিসাবে অভিহিত করেন। 

সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় মহামান্য মহাসংঘনায়কের নেতৃত্বে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে বুদ্ধের আড়াই হাজারতম পরিনির্বাণ জয়ন্তী, ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে থাইল্যান্ডের রাজা-রাণী ধর্মরাজিক পরিদর্শন, ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে জাপানে বিশ্বধর্ম ও শান্তি সম্মেলনে যোগদান এবং বিশ্বশান্তির জন্য লুভনা, বেলজিয়াম ও নয়াদিল্লি গমন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ডের সচিব মনোনীত, ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ'র রজতজয়ন্তী, ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে অতীশ দীপঙ্করের সহস্রতম জন্মজয়ন্তী, ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান অগ্রসার মহাকমপ্লেক্স পরিদর্শন করেন, ঐ বছর সরকার বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করলে তাঁকে সহ-সভাপতি মনোনীত করেন। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ব ধর্ম শান্তি  সম্মেলন ও এশিয়া ধর্ম শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে চীন, কোরিয়া, পশ্চিম জার্মানী, আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া পরিভ্রমণ কালীন সময়ে বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকায় বিশ্বশান্তির স্বপক্ষে বক্তব্য রাখেন। ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে পাহাড়পুরে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ তাঁকে বাংলার নব অতীশ দীপঙ্কর বলে আখ্যায়িত করেন। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের ফাস্ট লেডি অগ্রসার মহাকমপ্লেক্স পরিদর্শন করেন, ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে সারনাথ মূলগন্ধ কুঠি বিহারের ৫৮তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে সভাপতিত্ব করেন। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে ভারতের বুদ্ধগয়ায় "বুদ্ধগয়া বাংলাদেশ বৌদ্ধ বিহার" প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া তিনি তাঁর সুদীর্ঘ পথ-পরিক্রমায়  বিশ্বের দেড় শতাধিক দেশ সফর ও এক হাজারেরও বেশি আন্তর্জাতিক সম্মেলন-সমাবেশে যােগদান করে স্বদেশের কৃষ্টি ও ঐতিহ্য তুলে ধরেন। 

বাঙালি বৌদ্ধ সমাজ, বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা বশত আন্তর্জাতিক মর্যাদায় ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মজয়ন্তী, ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে হিরক জন্মজয়ন্তী, ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে পূনর্মিলনী, ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে প্লাটিনাম জন্মজয়ন্তী মহাসমারোহে পালন করেন। এসব অনুষ্ঠানে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীবর্গ, বিভিন্ন দেশের সরকারি প্রতিনিধি, আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বিদগ্ধ পণ্ডিতবর্গ উপস্থিত থেকে মহাথেরকে পরম শ্রদ্ধায় এ যুগের বোধিসত্ত্ব, বাংলার নব অতীশ, ভ্রাম্যমান রাষ্ট্রদূত হিসাবে অভিহিত করেন। বিশ্বশান্তি ও আন্তঃধর্মীয় সংহতি প্রচারে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে মহামান্য মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের এশিয় বৌদ্ধ শান্তি সম্মেলন সংস্থা কর্তৃক "শান্তি সুবর্ণ পদক" এবং ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে নরওয়ের গান্ধী পীস ফাউন্ডেশন কর্তৃক আন্তর্জাতিক শান্তি পুরষ্কারে ভূষিত হন। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে মহাসংঘনায়কের অন্তেষ্টিক্রিয়া উপলক্ষে ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশ ডাক বিভাগ মহাসংঘনায়কের স্মৃতি রক্ষার্থে "স্মারক খাম" প্রকাশ করেন, ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সমাজ সেবায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জাতীয় পুরষ্কার "একুশে পদক" (মরণোত্তর) প্রদান করে জাতীয় মর্যাদায় অভিষিক্ত করেন। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডাক বিভাগ বিশ্বের স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের স্মরণে স্মারক ডাক টিকেট প্রকাশ করেন। 

এভাবে কর্মযোগের মাধ্যমে ক্ষণজন্মা এই মহান পূণ্যপুরুষ বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংঘ মনীষা রুপে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কে পরিনত হন। মহামান্য মহাসংঘনায়ক শ্রীসদ্ধর্মভাণক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে ০২ মার্চ সমগ্র বৌদ্ধ সমাজকে শোক সাগরে ভাসিয়ে ৮৬ বছর বয়সে মহাপ্রয়াণ করেন। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের ১৩ ফেব্রুয়ারি জাতীয় অন্তেষ্টিক্রিয়া উদযাপন পরিষদের মাধ্যমে যথাযথ ধর্মীয় ও জাতীয় মর্যাদায় তাঁর জন্ম জনপথ হোয়ারাপাড়া গ্রামের তারই স্বপ্নের ঠিকানা অগ্রসার কমপ্লেক্সে অন্তেষ্টিক্রিয়া সুসম্পন্ন হয়। বাংলার বৌদ্ধ সমাজ তাঁর কাছে চিরঋণী হয়ে রইল।

লেখক পরিচিতিঃ সেক্রেটারী, লায়ন্স ক্লাব অব চিটাগাং কর্ণফুলী এলিট।

নিউজটি আপডেট করেছেন : Suprobhat Michigan

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ
একুশে পদকপ্রাপ্ত বরেণ্য বৌদ্ধ ভিক্ষু বিশুদ্ধানন্দ মহাথের'র কর্ম ও জীবন 

একুশে পদকপ্রাপ্ত বরেণ্য বৌদ্ধ ভিক্ষু বিশুদ্ধানন্দ মহাথের'র কর্ম ও জীবন