আমেরিকা , মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫ , ৯ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
ডেট্রয়েটে শতবর্ষের তাপমাত্রা রেকর্ড ডেট্রয়েটে আতশবাজি অনুষ্ঠানে গুলির আতঙ্ক ডেট্রয়েটে তাপপ্রবাহের মাঝেও হাজারো দর্শক ফোর্ড ফায়ারওয়ার্কসে মাতোয়ারা ক্লে টাউনশিপের পার্কিং লটে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত মানবতা বাঁচাও : শান্তি এখনই দরকার আর্দ্রতা-সহ গরমে হাঁসফাঁস মিশিগান, তাপ সূচক ছুঁবে ১০৫ ক্যাস লেকে ডুবে ডেট্রয়েটের এক যুবকের মৃত্যু ওয়েইন কাউন্টিতে দলিল জালিয়াতি রোধে নতুন আইন ও সতর্কবার্তা রয়েল ওক টাউনশিপে গুলিবর্ষণে নিহত ১, আহত ৩  পুলিশের গাড়ির ধাক্কায় আহত নারী পেলেন ২.৯৫ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ ইরানের তিন পরমাণু কেন্দ্রে আমেরিকার হামলা সাউথগেট পুলে ডুবে ২ বছর বয়সী শিশুর মৃত্যু সাউথগেটে দুই পুলিশকে গুলি, সন্দেহভাজন গ্রেপ্তার গ্রীষ্মের প্রথম ঢেউ : মেট্রো ডেট্রয়েটে অতিরিক্ত তাপে সাবধান ময়মনসিংহে বাসের ধাক্কায় নিহত ৬, বাসে আগুন  মনরো কাউন্টিতে দাগযুক্ত লণ্ঠন মাছি: অচিরেই বিস্তার ঘটবে ইউবেক আলোচনায় রাষ্ট্রদূতদের কণ্ঠে গণতন্ত্র ও বদলের প্রত্যাশা মেট্রো ডেট্রয়েটে তাপের দাপট, আর্দ্রতা ও বজ্রঝড়ের পূর্বাভাস বেডফোর্ডে রহস্যজনক মৃত্যু : কিশোরী ও পুরুষের মরদেহ উদ্ধার, তদন্তে পুলিশ শেখ হাসিনাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি

পর্ব ২ : স্বপ্নের দ্বীপে পা রাখা — ম্যাকিনাক আইল্যান্ড

  • আপলোড সময় : ০৪-০৬-২০২৫ ০১:০২:৩৯ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ০৪-০৬-২০২৫ ০১:০২:৩৯ পূর্বাহ্ন
পর্ব ২ : স্বপ্নের দ্বীপে পা রাখা — ম্যাকিনাক আইল্যান্ড
ফেরির ছাদ থেকে যখন দ্বীপটির নিসর্গরূপ সামনে আসছিল, তখন মনে হচ্ছিল যেন সময় একটু থেমে গেছে। লেক হিরনের জলরাশি চুম্বকের মতো টেনে নিচ্ছে মন, আর দ্বীপের সবুজাভ রেখা, তার ওপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা গ্র্যান্ড হোটেল—সব মিলিয়ে যেন কোনো কল্পনার ছবি।
ফেরি যখন তীরে এসে ভিড়ল, তখন আমাদের চোখের সামনে ফুটে উঠল এক অন্যরকম পৃথিবী। না, এখানে কোনো গাড়ির শব্দ নেই, হর্নের আওয়াজ নেই, কেবল ঘোড়ার টগবগ শব্দ আর মানুষের হাঁটার ছন্দ। পাথরের রাস্তা ধরে সারি সারি ঘোড়ার গাড়ি চলছে—তারা এখানকার প্রধান যানবাহন। রয়েছে প্রচুর সাইকেল চালানো পর্যটক, কিছু লোক হাঁটছেন—সবার মুখেই এক ধরনের প্রশান্তি। পাশেই দেখলাম গ্র্যান্ড হোটেলের অতিথিদের জন্য একটি ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, ঘোড়াগুলি এতই হৃষ্টপুষ্ট যে আমার বউ বলেই ফেলল, “আমি জীবনে এত হৃষ্টপুষ্ট আর সুন্দর ঘোড়া দেখি নি।”

দ্বীপে পা রাখার সাথে সাথেই বাতাসে একধরনের ঘোড়ার গন্ধ আর সাগরের লবণাক্ত সুবাস মিলেমিশে এক অপরূপ অনুভূতির জন্ম দেয়। আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল “ইন অন ম‍্যাকিনাক” হোটেল, ফেরিঘাট থেকে কাছেই, আর আমাদের জিনিসপত্রগুলি একটি ছোট ওয়াগনে ছিল, তাই আমরা হেঁটেই হোটেলে পৌঁছে যাই।
ম্যাকিনাক আইল্যান্ডে হোটেল পাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। অনেক দিন আগে থেকে হোটেল বুক না করলে হোটেল পাওয়া যায় না। আমার বন্ধুর মেয়ে তিয়াস (কর্নেল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী) কিভাবে যেন আমাদের জন্য হোটেল ম্যানেজ করে ফেলল। হোটেলটি ছোট কিন্তু খুবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, গোছানো।
একটু ফ্রেশ হয়ে কাপড়চোপড় বদলে আমরা বের হয়ে গেলাম মেইন স্ট্রিটে, যেখানে সারি সারি দোকান, চকোলেট ফ্যাক্টরি, গিফটের দোকান আর ক্যাফেগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে যেন কোনো পুরোনো সিনেমার দৃশ্য।

আমাদের মেয়েরা খুশিতে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে, হাতে ম্যাপ নিয়ে ঠিক করছে কোথায় কোথায় যাবে। আমরা প্রথমেই গেলাম ম্যাকিনাক আইল্যান্ডের বিখ্যাত Fort Mackinac। ১৭৮০ সালে ব্রিটিশরা এই কেল্লাটি তৈরি করেছিল এবং এটি আমেরিকার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। ভিতরে সৈন্যদের কক্ষ, যুদ্ধ সরঞ্জাম, চিকিৎসাকক্ষ—সবকিছুই সংরক্ষিত রয়েছে, কিন্তু সেই দিন কোনো এক কারণে ফোর্টটি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ ছিল, তাই আমরা দেখতে পারিনি।
এরপর আমরা সাইট সিয়িংয়ের ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে বসলাম আরও অনেক পর্যটকের সাথে। ঘোড়ার গাড়ির স্ট্যান্ডটি ঠিক ফেরিঘাটের উল্টোদিকে। কেউ চাইলে ফেরি থেকে নেমেই ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া নিতে পারেন। ট্যাক্সি হিসেবেও ভাড়া নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। আর ফেরিঘাটের ঠিক পাশেই আছে সাইকেল স্ট্যান্ড, যেখান থেকে সাইকেল ঘণ্টা হিসেবে ভাড়া নেওয়া যায়।
ম্যাকিনাক আইল্যান্ডে ঘোড়ার গাড়ির চালকেরা আবার ট্যুর গাইডের কাজটিও করে নেয়। চলতে চলতে বর্ণনা করে প্রতিটি দর্শনীয় স্থানের। ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে আমরা যে সব দর্শনীয় স্থান ঘুরেছি তার বর্ণনা নিচে দিলাম:

১. আর্চ রক (Arch Rock):
এই প্রাকৃতিকভাবে গঠিত চুনাপাথরের খিলান আকৃতির পাথরটি দ্বীপের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। প্রায় ১৪৬ ফুট উঁচু এই গঠনটি দেখতে নিচ থেকে অনেকটা তোরণের মতো মনে হয়। চালক বললেন, স্থানীয়দের মতে এই গঠনটি আদিবাসীদের কাছে একসময় পবিত্র স্থান ছিল। আমরা একটি ছোট ট্রেইল ধরে উপরে উঠে গিয়েছিলাম—সেখানে দাঁড়িয়ে একদিকে ছিল বন, অন্যদিকে দূর বিস্তৃত লেক হিরনের রূপালী জলরাশি।

২. সেন্ট অ্যান’স চার্চ (St. Anne’s Church):
ঘোড়ার গাড়ির যাত্রাপথে পড়ল এই শতাব্দী প্রাচীন ক্যাথলিক গির্জাটি। সাদা কাঠের গঠন, সবুজ জানালা আর তার পাশের ছোট কবরস্থান যেন ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। দ্বীপে ধর্মীয় প্রার্থনার জন্য এটাই ছিল প্রথম গির্জাগুলোর একটি।

৩. গ্র্যান্ড হোটেল (Grand Hotel):
আমরা ঘোড়ার গাড়িতে হোটেলের সামনের অংশ পর্যন্ত গেলাম। চালক জানালেন, ১৮৮৭ সালে তৈরি এই হোটেলটিতে আছে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ কাভার্ড বারান্দা (৬৬০ ফুট)। ভিতরে প্রবেশ করতে চাইলে দর্শনার্থীদের জন্য আলাদা টিকিটের ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের সময় না থাকায় আমরা বাইরে থেকেই দেখে মুগ্ধ হলাম, আর ছাদ থেকে উঁকি দেওয়া আমেরিকান পতাকাটা যেন পুরো দৃশ্যটিকে সিনেমাটিক করে তুলছিল।

৪. সার্কুলার রোড (M-185):
এই রাস্তা আমেরিকার একমাত্র মোটরবিহীন হাইওয়ে। ঘোড়ার গাড়ি এই পথে অনেকটা সময় নিয়ে দ্বীপের চারপাশ ঘুরে দেখে। লেক হিরনের ধারে এই রাস্তাটি বাইসাইকেল চালকদের জন্যও প্রিয়। সেদিন আমরা দেখলাম, অনেকে দম্পতি বা পরিবার নিয়ে ধীরে ধীরে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে—হাওয়ার ছোঁয়ায় তাদের চুল ওড়ছে, চোখে প্রশান্তির ছোঁয়া।

৫. গিলবার্ট পয়েন্ট (Gilbert’s Point):
এই স্থানটি ঘোড়ার গাড়ির যাত্রাপথের এক নিস্তব্ধ অংশ। একপাশে হালকা জঙ্গল, আরেকপাশে শান্ত জলের ধারে কিছু কাঠের বেঞ্চ রাখা। আমরা কিছুক্ষণ নামলাম, ছবি তুললাম। বাতাসে হালকা নোনা গন্ধ, আর পাখিদের ডাক—পুরো পরিবেশটাই যেন এক অলীক বাস্তব।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল চলে এলো। আমরা আবার ফিরে এলাম মেইন স্ট্রিটে। মেয়েরা চকোলেট ফ্যাক্টরি থেকে ফাজ কিনল—ম্যাকিনাকের বিখ্যাত ফাজ, যা না খেয়ে দ্বীপ থেকে ফেরা মানেই না আসা।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার আগে আমরা লেকের ধারে গিয়ে বসে রইলাম। সূর্যটা ধীরে ধীরে জলের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে, আর তার লালচে প্রতিচ্ছবি লেক হিরনের বুকে রূপালী রেখা এঁকে চলেছে। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল—এই দ্বীপ, এই অনুভূতি, এই সময়—সবই যেন কোনো দীর্ঘ স্বপ্নের অংশ, যা বাস্তবের ছোঁয়ায় আরও গভীর হয়ে উঠেছে।
রাতটা ছিল একেবারেই স্বপ্নময়। আমাদের দলের একজন মেয়ে বয়সে ১৮-উর্ধ্ব হওয়ায় আমরা স্বস্তিতে বাচ্চাদের তাকে হোটেলে রেখে দিতে পারি। সেদিন রাতে আমরা দুই দম্পতি হাতে হাত রেখে বেরিয়ে পড়ি দ্বীপের নিঃশব্দ অন্ধকারে, যেখানে কেবল বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ, পেছনে কোলাহলহীন হোটেলগুলো আর সামনে প্রশান্ত লেক হিরনের গর্জনশূন্য ঢেউ। আমরা অনেক রাত পর্যন্ত বিচের পাশ দিয়ে হাঁটলাম—একটা মুহূর্তে থেমে তাকালাম আকাশের দিকে, যেন সমস্ত তারা এসে জড়ো হয়েছে আমাদের এই মধুর মুহূর্তের সাক্ষী হতে।
আমরা হাঁটছিলাম—চোখে চোখ রেখে, দীর্ঘশ্বাসে ভালোবাসা ভরে; এমন মুহূর্তের বর্ণনা দেওয়া সত্যিই কঠিন—এ যেন অনুভবের বিষয়, ভাষার সীমার বাইরে।

পরদিন সকালে নতুন সূর্য উঠল আরেকটি অভিযানের ডাক নিয়ে। আমরা সকলে সাইকেল ভাড়া করলাম ফেরিঘাটের পাশের স্ট্যান্ড থেকে। ছোটরা, বড়রা—সবাই মিলে রওনা হলাম দ্বীপের চারপাশ ঘুরে দেখার উদ্দেশ্যে। ম্যাকিনাক আইল্যান্ডের বিখ্যাত M-185 হাইওয়ে ধরে আমরা পুরো দ্বীপটি সাইকেল চালিয়ে প্রদক্ষিণ করলাম। পথের দু’পাশে কখনও পাহাড়ের ঢালু, কখনও বন, আর মাঝে মাঝে জলের গা ঘেঁষে তৈরি রাস্তা, যেখানে হিরনের হাওয়ার সাথে সাথে আমাদের মনও যেন মুক্ত হয়ে উড়ে গেল। কেউ কেউ থেমে ছবি তুলছে, কেউ ছোটদের সাহায্য করছে—সবাই একসাথে, এক ছন্দে, যেন কোনো সিনেমার দৃশ্য।
৮.২ মাইল সাইকেল চালালাম—কোনো ক্লান্তি অনুভব না করেই।
ম্যাকিনাক আইল্যান্ডে এই দিন ও রাত আমাদের স্মৃতির এমন একটি অধ্যায় হয়ে থাকবে, যা বারবার ফিরে দেখার মতো। এখানে যেন সময় থেমে নেই, বরং নিজস্ব ছন্দে এগিয়ে চলে—ভালোবাসা, প্রকৃতি, শান্তি আর আনন্দের ছন্দে।

নিউজটি আপডেট করেছেন : Suprobhat Michigan

কমেন্ট বক্স
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের অভাবনীয় কৃতিত্ব আটলান্টিক সিটির ইতিহাসে উজ্জ্বল অধ্যায়

বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের অভাবনীয় কৃতিত্ব আটলান্টিক সিটির ইতিহাসে উজ্জ্বল অধ্যায়