আমেরিকা , শুক্রবার, ১৩ জুন ২০২৫ , ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
ডেট্রয়েটে রেপো চালকের উপর গুলি চালানো মহিলাকে গুলি করল পুলিশ ডেট্রয়েটে বারবিকিউ পার্টিতে গুলিবর্ষণ, ৪ জন আহত এয়ার ইন্ডিয়ার ভয়াবহ দুর্ঘটনা: ২৪১ জন নিহত, বেঁচে আছেন মাত্র ১ জন তেহরানে ইজরায়েলের ভয়াবহ বিমান হামলা, জরুরি অবস্থা জারি ইরানে ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্সকে হত্যার  হুমকি ট্রাফিক লঙ্ঘনের দায়ে নির্বাসনের মুখে ডেট্রয়েটের কলম্বিয়ান তরুণ ডেট্রয়েটে পারিবারিক বিরোধে গুলি, একজন নিহত, একজন আহত সাসপেন্ডকৃত ম্যানেজারকে সিটি হল থেকে বহিষ্কার করলেন হ্যামট্রাম্যাক মেয়র বোমা হুমকির পর ট্রয় বিউমন্ট হাসপাতাল স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরেছে মিশিগানের আকাশে স্ট্রবেরি মুন আইল রয়্যাল জাতীয় উদ্যান থেকে দুই ক্যাম্পারের মৃতদেহ উদ্ধার রবীন্দ্র কাছারিবাড়িতে দর্শনার্থীর সঙ্গে বাকবিতণ্ডা, অডিটোরিয়ামে ভাঙচুর চীন থেকে জৈবিক উপাদান পাচারের  অভিযোগে ইউএমের আরো এক স্কলার গ্রেপ্তার লজ ফ্রিওয়ে দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তি ছিলেন ওয়েইন কাউন্টি শেরিফের ডেপুটি চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ডেট্রয়েটে দুইজনকে গুলি করে হত্যা, সন্দেহভাজন হেফাজতে রয়েল ওকে মেয়ের হাতে মায়ের মৃত্যু শিব মন্দিরে হৃদয়ছোঁয়া বাবা দিবস উদযাপন লস অ্যাঞ্জেলেসে সহিংসতা : গভর্নরের আপত্তি সত্ত্বেও ট্রাম্পের সেনা মোতায়েন মিশিগানের হলমিচ পার্কে ৮ হাজার মুসল্লির ঈদের নামাজ আদায়

সৈয়দ মুজতবা আলীর অবিস্মরণীয় শিল্পকর্ম শবনম  

  • আপলোড সময় : ১২-০৬-২০২৫ ১২:৩৭:৪৯ অপরাহ্ন
  • আপডেট সময় : ১২-০৬-২০২৫ ০১:৫১:১৬ অপরাহ্ন
সৈয়দ মুজতবা আলীর অবিস্মরণীয় শিল্পকর্ম শবনম  
কাজী নজরুল ইসলামের পর উভয় বাংলায় নন্দিত লেখক হিসেবে যাঁর নাম সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য, তিনি সৈয়দ মুজতবা আলী। বিশ্ব মানবিকতায় উদ্বুদ্ধ এবং বৈশ্বিক চেতনায় সমৃদ্ধ এ লেখকের সৃষ্টিশীল প্রতিভা শতধারায় উৎসারিত হয়ে বাংলা সাহিত্যকে নানা মণি-কাঞ্চনে সমৃদ্ধ করেছে।সাহিত্যক্ষেত্রে তিনি স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে প্রতিষ্ঠালাভে সক্ষম হবেন,রবীন্দ্রনাথের এ ঐকান্তিক আকাঙ্ক্ষা যথার্থই বাস্তবায়িত হয়। 
মূলত দেশে-বিদেশে(১৩৫৬) প্রকাশনার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে তাঁর প্রতিষ্ঠা অক্ষয় এবং অম্লান, একথা বলাই বাহুল্য। সেইসাথে অন্যান্য রচনাও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে অনন্য ।  শবনম এ ধারায় এক বর্ণোজ্জ্বল  সংযোজন।(প্রথম প্রকাশকাল ১৩৬৭)।

ভিন্ন স্বাদ এবং ব্যঞ্জনায় এ উপন্যাস 'দেশ' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে। (১৪ ই মে ১৯৬০-২৭ অগাস্ট ১৯৬০)। বিদেশী চরিত্র এবং আবহ বিনির্মাণে লেখকের অসাধারণ নৈপুণ্যের পরিচয় অনন্য গদ্য শৈলীর আশ্রয়ে আলোচ্য গ্রন্থে ভাস্বর হয়ে ওঠেছে। আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে তিনি যেন এক অমরাবতী সৃজন করেছেন। শবনমকে তিনি উপন্যাসরূপেই আখ্যায়িত করেছেন।এবং প্রমথনাথ বিশীর মত বিদগ্ধ সমালোচক সাহিত্যিকও এ বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করেছেন। দুটি তরুণ হৃদয়ের প্রেমোপাখ্যান শবনম উপন্যাসটি আদিগন্ত কল্পনার হিরণ্ময় আলোকে দীপ্র।

মজনুন নামে কেন্দ্রীয় পুরুষ চরিত্রের জবানীতে গ্রন্থের কাহিনী পল্লবিত। সুদূর কাবুল দেশে এক ঝলমলে সন্ধ্যায় আঠারো, ঊনিশের চটপটে সপ্রতিভ তরুণী শবনমের সাথে কথকের দেখা। এভাবে "প্রথম দেখেছিলুম কপালটি। যেন তৃতীয়ার ক্ষীণ চন্দ্র। শুধু চাঁদ হয় চাঁপা বর্ণের। এর কপালটি একদম পাগমান পাহাড়ের বরফের মতই ধবধবে সাদা। সেটি আপনি দেখেননি? অতএব বলব নির্জলা দুধের মত। সেওতো আপনি দেখেননি। তাহলে বলি বনমল্লিকার পাঁপড়ির মত। ...চোখ দু'টি নীল না সবুজ বুঝতে পারলুমনা। পরনে উত্তম কাটের গাউন। জুতো উঁচু হিলের।" (পৃঃ ১০২, শবনম)। বলতে গেলে উভয় পক্ষেই প্রথম দর্শনে ভালোবাসা। 

কথকের আত্মীয় পরিজনহীন নিরানন্দ, সুরহীন জীবনে কোত্থেকে যেন এক সোনার বাঁশি বেজে ওঠল। হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা ধনের অভূতপূর্ব প্রাপ্তিতে উভয়েই বিভোর। কিন্তু প্রেমের সেই ললিত কোমল অঙ্গনে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা কালবোশেখীর ইঙ্গিত নিয়ে আসে। ডাকাতের লুব্ধ দৃষ্টি থেকে বাঁচানোর জন্যে শবনমকে কথকের সাথে বিয়ে দেয়া হলেও শেষ রক্ষা হয়নি। ডাকাতদল তাঁকে ধরে নিয়ে গেলে বন্দীত্ব থেকে শবনমের রহস্যময় অন্তর্ধান। অতঃপর কথকের অন্তহীন বিরহ আর দিগন্ত বিথারি পথ চাওয়ার মাঝে সুগভীর আত্মোপলব্ধির বিষয়ে লেখক বলেন, "সঙ্গীত সমাপ্ত হওয়ার বহু বৎসর পরেও তাকে যখন স্মরণে এনে তার ধ্বনি বিশ্লেষণ করা যায় এযেন তারও পরের কথা। রাগিণী, তান, লয়, রস, সবে ভুলে গিয়ে বাকি থাকে যে মাধুর্য -সেই শুদ্ধ  মাধুর্য। অথচ বাস্তব জগতে সেটা হয় ক্ষীণ। এখানে যেন জেগে উঠে বানের পর বান। গম্ভীর, করুণ, নিস্তব্ধ,জ্যোর্তিময়। ওই তো শবনম।" (পৃঃ২৪৪)এখানেই গ্রন্থ  সমাপ্ত। গ্রন্থটির ট্র্যাজিক পরিণতি পাঠক হৃদয়কে বিশেষভাবে বেদনায় ভারাক্রান্ত করে তোলে। বলা যায়, সার্থক উপন্যাসে অভিপ্রেত আখ্যান ভাগ আলোচ্য গ্রন্থে সগৌরবে বর্তমান।

উপন্যাসের অন্যতম উপাদান সমাজ বা পরিবেশের বিবরণও আলোচ্য গ্রন্থে উপেক্ষণীয় নয়। গ্রন্থে বিদ্যমান যে সমাজ তা রক্ষণশীল। কোন ছেলে কোন মেয়ের বাড়িতে গিয়ে তার সাথে দেখা করতে চাইলে তা গুরুতর অন্যায় বলে গণ্য হয়। অতিথি পরায়ণতার চিত্রে দেখা যায়, অতিথি না খেয়ে উঠা পর্যন্ত গৃহস্বামীকে বসে বসে খাবার নাড়াচাড়া করার ভান করতে হয়, যেন তার খাওয়া তখনো শেষ হয়নি। ও দেশের পুরুষ সচরাচর মেয়েদের দিকে তাকাতে অভ্যস্ত নন। পুরুষদের জগৎ প্রসারিত। মেয়েরা বলতে গেলে অন্তঃপুরবাসিনী। কুমারী মেয়েরা কানের কাছে দুগুচ্ছ চুল ঝুলিয়ে রাখে। বিয়ের পর বর কর্তৃক ঐ 'জুলুপ 'কেটে দেওয়ার নিয়ম সে দেশে প্রচলিত। 

চরিত্র চিত্রণ সার্থক উপন্যাসে অন্যতম অপরিহার্য অনুষঙ্গ। প্যারিসে জন্মগ্রহণকারী উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তার কন্যা শবনম তাঁর চারিত্রিক সৌন্দর্য, মাধুর্য নিয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে প্রদীপ্ত শুকতারা। শবনম রূপবতী, শিক্ষিত,দৃঢ়চেতা। উচ্ছ্বল, চঞ্চল প্রাণ-তরঙ্গে উদ্বেল পাহাড়ি ঝর্না। চলায়,বলায় সুরুচি সম্পন্ন। আপনাতে আপনি বিকশিত রজনীগন্ধা। তাঁর নামেই কাব্যের লালিত্য।তিনি নিজেও কাব্য রসিক।বোদ্ধা। কথকের প্রতি তাঁর অন্তহীন ভালেবাসার কাব্যিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে এভাবে", গভীরে ডুবেছে যেজন, জানিবে মুক্তার সন্ধানে 
বুদ্বুদ হয়ে তাঁর প্রশ্বাস ওঠেনা উপর পানে।"(শবনম,পৃঃ১১৭)

শবনম সঙ্গীতেও পারদর্শী। বিভিন্ন ভাষায় তাঁর দক্ষতা ছিল প্রচুর। হাস্য-পরিহাস শবনমের মজ্জাগত। অপূর্ব বাক মাধুর্যে সমৃদ্ধ তাঁর কথাবার্তায় শাণিত ছুরির ধার। শবনম অঙ্কন শিল্পে পারদর্শী।কথককে বই উপহার দিতে গিয়ে ফুল, লতাপাতা আর পাখির ছবি এর উদাহরণ। শবনমের  আত্মবিশ্লেষণী মনোভাব প্রখর। নিজের দোষ ত্রুটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার সদিচ্ছা অপ্রতিরোধ্য। বস্তুত রূপের বৈভবে, ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা আর শিক্ষার আলোকে, মাধুর্য আর মহনীয়তায় সর্বোপরি ভালোবাসার অমল আলোয় উদ্ভাসিত শবনম চরিত্র গ্রন্থের মহামূল্যবান অলঙ্কার বিশেষ। 

ভাষা ভাবের প্রাণ। রচনার সার্থকতার পেছনে বলিষ্ঠ প্রাণময় ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। আলোচ্য গ্রন্থের ভাষা সম্পর্কে এক কথায় বলা যায়, অপরাপর দিক বাদ দিলেও শুধুমাত্র কাব্যিক প্রাণবন্ত ভাষার কারণে এটা একটা সার্থক শিল্প সফল উপন্যাস। লেখকের যথোপযুক্ত শব্দ চয়ন, বাক প্রতিমা নির্মাণে অসাধারণ নৈপুণ্য, অন্তঃগূঢ় ভাব প্রকাশে স্বতঃস্ফূর্ত দক্ষতা, নিজস্ব গদ্যশৈলী ভাষাকে করেছে পুষ্পিত,সুরভিত। অর্থাৎ তাঁর স্টাইল বাংলা ভাষায় একটা শক্তিশালী ভিন্নমাত্রা যুক্ত করেছে। ঝলমলে ভাষা ভাদ্রের নদীর মত প্রাণ তরঙ্গে বেগবান। রঙধনুর সাতরঙা আলোক বিচ্ছুরণে দীপ্র।   ভাষার উদাহরণ (ক) "এ যেন পূর্ণ চন্দ্রের দূরে দূরে কয়েকটি তারা ফুটানো হয়েছে চন্দ্রের গরিমা  বাড়ানোর জন্য। এ যেন উৎসব গৃহের সৌন্দর্যের মাঝখানে ধূপকাটি জ্বালানো হয়েছে।... বাতাসে বাতাসে পাতা গোলাপ সৌগন্ধের মাঝখানে বুলবুলের বীথি বৈতালিক।" (শবনম,১৮৩পৃঃ) 

(খ)
কাবুল নদীর ওপাড়ে সার বাঁধা পল্লবহীন দীর্ঘ তনঙ্গী চিনার গাছের দল দাঁড়িয়ে আছে বরফে পা ডুবিয়ে। যেন নগ্না গোপিনীর দল হর্ম্য সারির পশ্চিমে লুক্কায়িত রাধা মাধবচন্দ্রের কাছ থেকে বস্ত্র ভিক্ষা করছে।" (১৯৫পৃঃ) এ সমস্ত অংশ শিল্পশ্রীতে অনন্য। 
ভাষার সাথে সাথে সাহিত্যের নানারকম  অলঙ্কারেরমধ্যে উপমা, রূপকের প্রাচুর্য গ্রন্থে লক্ষণীয়ভাবে দৃষ্ট হয়।যেমন," ঘুঙুরওয়ালা চরণ চক্র পরা বাড়ির নতুন বউ চলাফেরা করার সময় যেরকম দক্ষিণী বীণা বাজে ওর গলার শব্দ সেই রকম।"(শবনম,পৃঃ১৩০)
এছাড়াও পাত্র পাত্রীর কথোপকথনে বিভিন্ন কবিতার উদ্বৃতি গ্রন্থের ভাষাকে শ্রীমণ্ডিত করেছে,

"প্রিয়ারে ছাড়িয়া থেকোনা হাফিজ!ছেড় না অধর লাল
এযে গোলাপের চামেলির দিন- 
এযে উৎসব কাল।" ( শবনম১৮৯পৃঃ)

উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে শত কণ্ঠে বলা যায়, আখ্যানভাগের অভিনবত্ব, চরিত্র সৃষ্টির নৈপুণ্য, বিদেশী আবহ,কাব্যিক উদ্ভাস,ভাষার ললিত মধুর আলিম্পন- সর্বোপরি গীতল মূর্ছনা শবনম উপন্যাসে এনেছে এক অন্যরকম প্রদীপ্তি। বইটি দুরন্ত দুর্বার গতিতে পাঠককে আকর্ষণ করে। শৈল্পিক উৎকর্ষে অনন্য এই  বই বিষয়ে কেউ বলেন এটি গদ্য কাব্য। কেউ বলেন রোমান্সজাতীয়।প্রমথনাথ বিশী লিখেছেন, "এ যেন প্রজাপতির পাখা শিশিরকণা ছড়িয়ে দিয়েছে মাঠের  ঘাসে। এ নতুন বর্ষার শেষের প্রথম শিশির বিন্দুর মতই  নূতন কোমল, মধুর আর সুকুমার।  রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালাতে বর্বরতা ও মাধুর্য দুই- ই রয়েছে । আলী সাহেব ওই মাধুর্যটুকু  ছিনিয়ে নিয়ে তৈরি করেছেন শবনমকে।"

লেখক : প্রফেসর  জাহান আরা খাতুন 
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ
হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ 
হবিগঞ্জ ।

নিউজটি আপডেট করেছেন : Suprobhat Michigan

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ
আটলান্টিক সিটিতে বিএএসজের ফুড ব্যাংক

আটলান্টিক সিটিতে বিএএসজের ফুড ব্যাংক