নিউ জার্সি, ১৮ জুন : দেশের মঞ্চ, টেলিভিশন এবং থিয়েটার জগতে এক অনবদ্য নাম—সাজু খাদেম। যে কোনো মাধ্যমেই—উপস্থাপনা হোক বা কমেডি, নাট্যনির্দেশনা হোক বা চরিত্রাভিনয়—সাজুর সক্রিয়তা বিস্ময়কর। শুধু অভিনয় নয়, তার প্রতিভা ছুঁয়ে গেছে অভিনয়ের ভাষা, বাচনভঙ্গি, দর্শকপ্রিয়তা এবং সময়ের চাহিদা সব কিছু।
আমার সৌভাগ্য, সাজু খাদেম ছিল আমার কলেজ জীবনের সহপাঠী। ১৯৯২ সালে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজে আমরা একসাথে পড়াশোনা করতাম। সে বছরই সাজু ঢাকায় চলে যায়, এবং তারপর কেটে গেছে ৩৩ বছর—এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে সে নিজেকে গড়ে তুলেছে বাংলাদেশের নাট্যজগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে। আজ সে আমেরিকার মঞ্চেও তার প্রতিভার দীপ্তি ছড়াচ্ছে।
যেখানে দেশের বাইরে মঞ্চনাটকের পরিধি তুলনামূলকভাবে সংকুচিত, সেখানে নিউইয়র্ক, হিউস্টন, ডালাসের কিছু নাট্যসংগঠন সাহসের সঙ্গে নাট্যচর্চা অব্যাহত রেখেছে। এই প্রবাসজীবনের সীমিত সুযোগের মধ্যেই সাজু খাদেম দেখালেন এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত। মঞ্চের সন্তান সাজু, আজও মঞ্চকেই হৃদয়ে ধারণ করেন।
সাজু খাদেমের নাট্যজীবনের এক অনন্য উজ্জ্বল অধ্যায় “ভুল থেকে ফুল”। শুধু অভিনয় নয়, এই নাটক ছিল তার শিল্পবোধ ও মানবিক গভীরতার এক অসামান্য নিদর্শন। এই নাটকে তার অভিনয় কাহিনীর গভীরতাকে এমনভাবে রূপ দিলো যে, দর্শক শুধু বিনোদিতই হয়নি, বরং সংবেদনশীল হয়ে পড়েছিল। ১৪ জুন, উত্তর আমেরিকার মঞ্চে সাজু খাদেম তার সৃজনশীলতা ও শিল্পমানসিকতা দিয়ে যেন ফিরিয়ে আনলেন এক সময়ের জনপ্রিয় কিন্তু আজ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া "যাত্রাপালা" সংস্কৃতিকে। সাজুর পরিবেশনা যেন একটি আত্মদর্শনের আয়না—নাটক কেবল বিনোদন নয়, একটি জীবনদর্শনও।
এপিক এক্টরস ওয়ার্কশপ ইউএসএ আয়োজিত সাউথ এশিয়ান থিয়েটার ফেস্টিভ্যালের ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বাংলাদেশের পক্ষে অংশ নেয় সূচনা থিয়েটার। মঞ্চস্থ হয় নাটক “ভুল থেকে ফুল”, যার রচনা ও নির্দেশনায় ছিলেন গুণী নাট্যব্যক্তিত্ব সাজু খাদেম। দারুণ উৎসবমুখর পরিবেশে ১৪ জুন বিকেল ৫:৩০-এ নিউ জার্সির ব্রান্সউইক পারফর্মিং আর্টস সেন্টারের আর্থার লরেন্স হলে সফলভাবে মঞ্চস্থ হয় নাটকটি। স্যাটায়ারধর্মী ‘ভুল থেকে ফুল’ নাটকের প্রতিটি সংলাপই দর্শকদের মন ছুঁয়ে যায়—প্রতিক্রিয়ায় মুহুর্মুহু করতালি ও হর্ষধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় পুরো মিলনায়তন। মঞ্চ, পোশাক, কোরিওগ্রাফি, আলো এবং অনবদ্য অভিনয়ে প্রতিটি দৃশ্য মূর্ত হয়ে উঠে ছবির মতো। লাইন রঙ এবং কম্পোজিশনে যোগ হয় নতুন মাত্রা।
সবচেয়ে আনন্দ এবং প্রাপ্তির বিষয় দর্শক সারিতে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে অধ্যাপক ড. ফার্লি রিচমন্ড - ডিপার্টমেন্ট অফ থিয়েটার এন্ড ফিল্ম- জর্জিয়া ইউনিভার্সিটি, ব্রডওয়ের আলাদীন খ্যাত আদি রায় সহ বাংলাদেশের প্রিয় নাট্য ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ, অধ্যাপক আব্দুস সেলিম এবং গবেষক বাবুল বিশ্বাস উপস্থিত ছিলেন ।
বিলুপ্ত প্রায় যাত্রা শিল্পের একজন শিল্পীর একাকিত্বের আবরণে মোড়া জীবনে রহস্যময় কিছু আগুন্তকের আগমনে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা নিয়েই ভুল থেকে ফুল। ব্যাঙ্গাত্বক ভঙ্গিতে এগিয়ে যাওয়া প্রযোজনাটিতে সেট ডিজাইনে সাজেস্টিভ ফর্ম এর ব্যাপারে জোর দেয়া হয়েছে। অভিনয় শৈলীতে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, আমাদের চিরন্তন আবেগ প্রকাশে কিছুটা অতিরঞ্জন। আলো, মঞ্চ, সঙ্গীত ও আবহসংগীত এর সমন্বয়ে কালার ফুল প্রযোজনা। দর্শক হাস্য রসাত্মক ভঙ্গিতে সমাজের অনেক অসংগতি খুঁজে পেয়েছে। তবে নির্মল আনন্দই ছিলো এর মূল উদ্দেশ্য।
নাটকের রচয়িতা, নির্দেশক, পরিকল্পনা, শিল্প নির্দেশক এবং প্রধান অভিনেতা সাজু নিজেই। সাজুর টীমে আরো যারা ছিলেন তারা হলেন- আলোক পরিকল্পনা: বাবর খাদেমি, আবু সুফিয়ান বিপ্লব
সঙ্গীত পরিকল্পনা: কামরুজ্জামান রনি, মঞ্চ পরিকল্পনা: সাজু খাদেম মঞ্চ সজ্জা এবং প্রপস : টিপু আলম, পোশাক - সাবিনা আহমেদ রুপা।
অভিনয়ে অংশ নেন হৃদি হক, সাজু খাদেম, সাইদ বাবু, তানভীর সামদানি, তামিমা তিথী, জান্নাত টুম্পা, শামসুদ্দিন । কোরিওগ্রাফি - সুবর্ণা খান কোরিওগ্রাফি টিম - সোমা মুখার্জি, মালিহা জামান, শিউলি পাল শম্পা এবং সাবিনা।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Suprobhat Michigan