আমেরিকা , বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫ , ১ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
মিশিগান আসছেন জামায়াত আমীর ডা. শফিকুর রহমান অবার্ন হিলসে সড়ক দুর্ঘটনায় ডেট্রয়েটের এক নারী নিহত মিশিগান রাজ্য পুলিশের বিরুদ্ধে বৈষম্যের অভিযোগে প্রাক্তন কর্মকর্তার মামলা ক্যান্টন টাউনশিপে ছুরিকাঘাতে আহত ৩ : আত্মীয় গ্রেপ্তার সারা মিশিগানে ‘আরএক্স কিডস’ কর্মসূচি সম্প্রসারিত হচ্ছে পুলিশ স্টেশন ‘উড়িয়ে দেওয়ার’ হুমকি : অভিযুক্ত লিভোনিয়ার বাসিন্দা মিশিগানে বাড়িতে গাড়ির ধাক্কা, বিছানা থেকে  উঠোনে ছিটকে পড়ে শিশু আহত পোর্ট হুরনে পেট্রোল পাম্পে গুলিবর্ষণে নিহত ১, নারী গ্রেপ্তার হবিগঞ্জে শিবির নেতা হত্যায় আমৃত্যু শফিকুল ও ১৩ জনের যাবজ্জীবন মিশিগানে এক মঞ্চে বই, শিল্প ও সংগীতের মিলনমেলা ভুল পথে গাড়ি চালিয়ে হত্যায় জ্যাকসনের ব্যক্তির দীর্ঘ সাজা ট্রয় ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাতে অভিযুক্ত সাবেক টেলার মেডিকেড প্রতারণায় অভিযুক্ত তিন মেট্রো ডেট্রয়েটবাসী ট্রাম্প নয়, শান্তিতে নোবেল পেলেন  ভেনেজুয়েলার মারিয়া কোরিনা  ম্যাকডোনাল্ডস ম্যানেজারকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত মহিলা বিচার যোগ্য ঘোষণা ‘দ্য মিউল’-এর অনুপ্রেরণা সেই মাদকচক্রের সহযোগী ফের গ্রেপ্তার ডেট্রয়েটে মায়ের দেওয়া ছুরি দিয়ে সহপাঠীকে ছুরিকাঘাত : মা-ছাত্রী গ্রেপ্তার ডেট্রয়েটের তিন ক্যাসিনো ঘিরে অপরাধের ছায়া ওমানে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ বাংলাদেশি নিহত, ৭ জনই সন্দ্বীপের মিশিগানে মানব পাচার চক্র পরিচালনায় দোষী চীনা নারীর কারাদণ্ড

মধুসূদন দত্তের চতুর্দশপদী কবিতাবলী : প্রেক্ষিত হৃদয়ার্তি 

  • আপলোড সময় : ১৬-১০-২০২৫ ০১:২৮:৪৬ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ১৬-১০-২০২৫ ০১:২৮:৪৬ পূর্বাহ্ন
মধুসূদন দত্তের চতুর্দশপদী কবিতাবলী : প্রেক্ষিত হৃদয়ার্তি 
উনিশ শতকের নবজাগরণের মানসপুত্র হিসেবে যাঁর নাম বাংলা সাহিত্যাকাশে প্রদীপ্ত শুকতারার মত ভাস্বর, তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাঁর চিত্তস্ফূর্তি ঘটে নবজাগরণের দীপ্ত আলোকে। মন- মনন তথা মানসলোক নতুন কিরণে স্নাত হয়ে সৃষ্টিশীল বিভঙ্গে সচকিত ও উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। তখন শতধারায় উৎসারিত হয় মধুসূদনের  কালজয়ী সৃজন- প্রতিভা। আর এর পেছনে অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মত কাজ করেছে পাশ্চাত্য প্রভাব। এ বিষয়ে মোহিতলাল মজুমদার বলেন," যে সংস্কৃতি একদা  য়ুরোপে নবজাগরণ আনিয়াছিল, যাহার ফলে humanities  বা মানববিদ্যা ব্রহ্মবিদ্যার উপরে স্থান পাইয়াছিল এবংমনুষ্য জীবনগত পরম রহস্যের প্রতি শ্রদ্ধা  বা humanism- ই মানুষকে নবধর্মে দীক্ষিত  করিয়াছিল। আমাদের পক্ষেও তাহা সঞ্জীবন মন্ত্রের মত কাজ করিয়াছিল, সেই মানবতা বা মর্ত্যপ্রীতির প্রেরণাই আমাদিগকে চঞ্চল করিয়াছিল। এই যুগপ্রভাব বা যুগ প্রবৃত্তিই মধুসূদনের জীবন ও তাঁহার কবি প্রকৃতিকে আশ্রয়  করিয়াছিল।" ১

মধুসূদন বিদ্রোহী কবি । তাঁর বিদ্রোহ ভিন্নমাত্রার। আঙ্গিকের অভিনবত্বে,  ভাষার ওজস্বিতায়, ছন্দের মূর্ছনায়, ভাবের গভীরতায়, প্রকাশের ঋজুতায়, জীবনবোধের ভিন্নতায়, মূল্যবোধের প্রসারতায় সর্বোপরি শিল্পের  হিরণ্ময় উদ্ভাসে মধুসূদন বিপ্লবী কবি এবং নতুন দিগন্তের পথপ্রদর্শক। 
তাঁর শিল্প -ঋদ্ধ সোনালিফসল নিম্নরূপ _
'তিলোত্তম সম্ভব কাব্য' ',মেঘনাদবধ কাব্য, ' 'ব্রজাঙ্গনা'( কাব্য),  'বীরাঙ্গনা' (পত্রকাব্য) 
'শর্মিষ্ঠা,'
'পদ্মাবতী,' 'কৃষ্ণকুমারী '(নাটক), 'একেই কি বলে সভ্যতা ','বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ '(প্রহসন) 'চতুর্দশপদী  কবিতাবলী 'প্রভৃতি । 


মাইকেল মধুসূদন দত্তের শেষ কাব্য 'চতুর্দশপদী কবিতাবলী' বাংলা সাহিত্যে অমূল্য সংযোজন।  এর মাধ্যমে কবি বাংলা সাহিত্যে একটি নতুনধারার সূত্রপাত করেছেন। ১৮৬৫ সালে ফ্রান্সে অবস্থানকালে  এই সনেটগুচ্ছ রচনা করেন। ১৮৬৬ সালে 'চতুর্দশপদী কবিতাবলী' নামে  কবির শেষ কাব্যগ্রন্থ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। 
এবার চতুর্দশপদী  কবিতা  বা সনেট বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করা যাক। 

"সনেট শব্দটি ইটালিয়ান 'সনেটো' (মৃদু ধ্বনি) শব্দ হইতে উদ্ভূত। ইহা একপ্রকার মন্ময় কবিতা। একটি মাত্র অখণ্ড ভাব কল্পনা বা অনুভূতি -কণা যখন ১৪ অক্ষর সমন্বিত (কখনো কখনো ১৮ অক্ষরও ব্যবহৃত হয় )  চতুর্দশ পঙক্তিতে একটি বিশেষ ছন্দ রীতিতে আত্মপ্রকাশ করে, তখন আমরা উহাকে সনেট নামে অভিহিত  করি। ইটালিয়ান কবি Petrarch  ইহার জন্মদাতা ।"  ২
এ ধারায় আছেন দান্তে, শেক্সপিয়ার, মিল্টন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কিটসসহ আরো অনেক সুবিখ্যাত সনেট রচয়িতা।
মধুসূদন দত্ত ১৪ অক্ষরই বাংলা সনেটের জন্য নির্ধারণ করেছিলেন। কৃতী  সনেট- শিল্পীরা  এ নিয়মই অনুসরণ করেছেন।  
সনেট রচয়িতা হিসেবে মধুসূদনের নাম অনন্য মর্যাদায় সমাসীন। "তাঁর চতুর্দশপদী নিঃসংশয়ে রোমান্টিক গীতিকবিতার অগ্রদূত। এই সনেটরূপের প্রবর্তন করে তিনি বাংলা কাব্যের সমগ্র ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করেছেন "। ৩
ইতালির কবি পেত্রার্কের  আদর্শে মধুসূদন অধিকাংশ সনেট রচনা করলেও মিল্টনের প্রভাবও  আছে।  

মধুসূদন সৃজিত 'চতুর্দশপদী কবিতাবলী' কেবলমাত্র আঙ্গিকগত সৌকর্যের কারণেই  উল্লেখযোগ্য নয়,  বিষয়গতদিকেও  এগুলোর স্বতন্ত্র মূল্য বিদ্যমান।  এ সমস্ত কবিতায় ব্যক্তি মধুসূদনের বহুবিচিত্র অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এখানে আছে আপন দেশ, জাতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে  মধুসূদনের নিবিড়তম পরিচয়। কখনো আবার বিভিন্ন দেশের কবি সাহিত্যিক ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের উদ্দেশে তিনি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন। এদেশের কবি-সাহিত্যিকদের প্রতিও তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা ছিল। চতুর্দশপদী বহু কবিতায় এ শ্রদ্ধাবোধের কোমল চিত্র ফুটে ওঠেছে। স্বতঃস্ফূর্ত কণ্ঠে তাঁদের কীর্তিগাথা স্মরণ করে জয়গান গেয়েছেন।কোনো কোনো কবিতায় আবার নীতি, ধর্মতত্ত্বের ছায়াপাত ঘটেছে। একান্ত নিজস্ব প্রেমানুভূতির পেলব  আলিম্পনে কিছু কিছু কবিতা দীপ্তিমান।প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের তরঙ্গাভিঘাতেও  আন্দোলিত হয়েছে বহু চতুর্দশপদী কবিতা। মূলত মধুসূদনের সনেটগুচ্ছ বিষয়-বৈচিত্র্যে সমুজ্জ্বল।

এরপরও দেখা যায় চতুর্দশপদীর বীণায় বিচিত্র রকম সুরের ঢেউ জাগলেও একটা বিশেষ সুর বারবার পাঠক -হৃদয়কে আপ্লুত করেছে।বিষাদিত করেছে।তা হল, কবির একান্ত নিজস্ব নিভৃত হৃদয়ের বেদনানুভূতি। দুঃসহ একাকীত্ব ও অন্তর্লীন হতাশার শৈল্পিক অভিব্যক্তি সনেটগুচ্ছকে দিয়েছে অভিনব প্রদীপ্তি। শিল্পের ভিন্নতর অবয়ব।এবার আমরা সেদিকেই আলোকপাত করব।

মধুসূদনের জীবনের চতুর্দিকে ছিল তরঙ্গ -বিক্ষুব্ধ লোনা সমুদ্র। বারবারই তাঁকে বিরুদ্ধ ঢেউয়ের সঙ্গে  লড়তে হয়েছে।বৈরী বাতাসের ঝাপটায় বিক্ষত  হয়েছে তাঁর জীবন, সাজানো স্বপ্ন। তিনি বারবার নিজের অজান্তেই কামনার সবটুকু রঙ ঢেলে স্বপ্নের বাসর সাজিয়েছেন।    কিন্তু সারা জীবন বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থারসাথে সংগ্রাম করতে করতে তাঁর অন্তরাত্মা জর্জরিত হয়েছে। রক্তাক্ত  হয়েছে।  আশার প্রদীপ বারবার নিভে গেছে। প্রত্যাশার  আকাশ ভরে গেছে হতাশার কালো মেঘে।এজন্যই নতুন বছর কবি হৃদয়ে কোনো সাড়া জাগাতে পারেনি। কেবল অস্তায়মান সূর্যের বিধুর প্রতিচ্ছবি বিনাশের কথা বলেছে। বিলুপ্তির ছবি দেখিয়েছে। নতুন বছরের উদীয়মান সূর্য তাঁর হতাশাচ্ছন্ন বিশুষ্ক হৃদয় -বাগানে আশার কোনো ফুলই ফুটাতে পারেনি।বরঞ্চ নতুন বছরে
তিনি জীবনের ব্যর্থতার কথা স্মরণ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন।তাই 'নতুন বছর 'কবিতায় শোনা যায় ব্যথা-দীর্ণ কবি হৃদয়ের হতাশার গুঞ্জরণ –

"হৃদয় কাননে -
কত শত আশালতা শুকায়ে মরিল,
হায়রে,কব তা কারে,কব তা কেমনে। "

নতুন বছরে কবি অনুভব করলেন আস্তে আস্তে ফুরিয়ে যাচ্ছে জীবনের বাসন্তী উৎসব। মহাকালের অমোঘ আবর্তনে জীবন ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে সেই অন্তিম পরিণতির দিকে।একসময় জীবনতরি তলিয়ে যাবে অনন্ত অন্ধকারের অতল সমুদ্রে।তাই' নতুন বছর'কবিতার অন্যত্র শোনা যায় কবি হৃদয়ের বেদনাবিধুর মূর্ছনা–

"বাড়িতে লাগিল বেলা ডুবিবে সত্বরে
তিমিরে জীবন রবি।"

'যশঃ' কবিতায় প্রতক্ষ্যভাবে হতাশার সুস্পষ্ট কোনো ছাপ না থাকলেও পরোক্ষভাবে এখানে একটা সন্দেহের, এক ধরনের সংশয়ের চিত্র ফুটে ওঠেছে। মহাকালের দুর্বার গতি প্রত্যক্ষ করে কবি বেদনাবিদ্ধ।সময়ের দুরন্ত স্রোতের খপ্পরে পড়ে হয়ত বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবেন, এ সংশয়ে তিনি আন্দোলিত।এজন্যেই কবি হৃদয়ের আর্ত হাহাকার–
"লিখিনু কি নাম মোর বিফলে যতনে বালিতে,রে কাল তোর সাগরের তীরে?"

ধরে রাখার প্রবণতা মানুষের চিরন্তন। জীবন থেকে যা হারিয়ে যায় আমরা তাকে বেঁধে রাখতে চাই স্মৃতির সুষমা দিয়ে। জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি- কান্নার টুকরো টুকরো কত ছবি নিজের অজান্তেই আমরা হৃদয়পটে অঙ্কন করে রাখি।কোনো অলস বেলায় নির্জন নিরালা মুহূর্তে  সুদূরে যেন বেজে উঠে স্মৃতির বাঁশি।আমরা আনমনা হয়ে যাই।হৃদয় আকাশে ভেসে উঠা স্মৃতির রঙধনুর দিকে ব্যাকুল আগ্রহে  চেয়ে থাকি।মধুসূদনের জীবনেও বারবার অমন হয়েছে। তাই দেখা যায় সুদূর ফরাসি দেশের নিঃসঙ্গ মুহূর্তে নিথর একাকীত্বের মাঝে কবির মনে পড়ে তাঁর দেশের কথা।

শৈশব-কৈশোরের সোনালি স্মৃতি বিজড়িত কপোতাক্ষ নদের নৃত্য-চপল তরঙ্গ- বিভঙ্গ কবিকে ডাকে।কেবল ডাকে।তাঁকে উদাস করে তোলে।স্মৃতির আবাহনে বিহ্বল কবি  ব্যগ্র দুবাহু বাড়িয়ে বলে উঠেন আপন হৃদয়ের ঐকান্তিক ভালবাসার কথা।সনেট' কপোতাক্ষ নদ' এ অনুভূতি সুধা গন্ধে হিল্লোলিয়া ওঠেছে,  –

"সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে    । 
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।
সতত(যেমতি লোক নিশার স্বপনে শোনে মায়া যন্ত্র-ধ্বনি)তব কলকলে,
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে!"

সুদূর ফরাসি দেশে গিয়ে কবি নিজের ভুল বুঝতে পারলেন।অনুভব করলেন তাঁর দেশ,তাঁর মাতৃভাষা দীন -হীন নয়।বরং নানারকম  মণি-কাঞ্চনে,অতুল ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ। তাঁর সুবিখ্যাত সনেট 'বঙ্গভাষা'য় শোনা যায় অসহায় কবি মনের  একাকীত্বের সুর। কাব্যগন্ধী নৈরাশের আর্তনাদ_ 

"হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন
তা সবে(অবোধ আমি) অবহেলা করি
পরধন লোভে মত্ত করিনু ভ্রমণ,
পরদেশে ভিক্ষা বৃত্তি কুক্ষণে আচরি।"
এ কবিতাটি সর্বগুণে  দীপ্ত।  "বিস্ময়কর পরিমিতিবোধের পরিচয় দিয়েছেন কবি  তাঁর শব্দ  ব্যবহারে। এ কবিতায় অপরিহার্য কতগুলো শব্দের যে দীপ্তিময় বিন্যাস ঘটেছে,  তাকে যথার্থ কাব্যস্বরূপের বাণীমূর্তি বলা যেতে পারে । "৪

কবির সৃষ্টি ক্ষমতার সেই প্রদীপ্ত সূর্য আজ অস্তমিত।একাধিক অসমাপ্ত রচনা সে নির্মম সত্যটাকেই যেন বারবার জানান দিয়ে যায়।এসব অসমাপ্ত রচনাবলি যেন সে অবসানের স্তূপীকৃত ব্যর্থতা বহন করে দুঃসহ যন্ত্রণায় গুমরে গুমরে মরছে।তাই কবি বিক্ষত।আর এই ক্ষয়িষ্ণু' অবক্ষয়িত মনের বেদনার্ত অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করেছেন'সুভদ্রা হরণ'নামক সনেটের ভাষায়–

"তোমার হরণগীত গাব বঙ্গাসরে
নবতানে,ভেবেছিনু সুভদ্রা সুন্দরী;
কিন্তু ভাগ্য দোষে, শুভে আশার লহরী
শুখাইল! যথা গ্রীষ্মে জলরাশি সরে।"

'সমাপ্তে' কবিতায় একই অনুভূতির  বেদন -কাতর মূর্ছনা  শোনা যায়।এ কবিতায় কবি হারানো দিনের সেই মোহন,মধুর,ঝিলিমিলি দিনগুলোর কথা স্মরণ করে অথির বেদনায় উদ্বেল হয়ে  ওঠেছেন।তাঁর জীবনী শক্তির প্রদীপ আস্তে আস্তে নিভে যাচ্ছে। এ উপলব্ধি কবিকে অধীর করে তুলেছে। তাই  আমরা প্রত্যক্ষ করি ব্যক্তি মধুসূদনের হৃদয় মথিত হতাশার বিধুর আলিম্পন–

"বিসর্জ্জিব আজি মাগো বিস্মৃতির জলে
( হৃদয়-সন্তাপ,হায় অন্ধকার করি;)
ও প্রতিমা নিবাইল,দেখ,হোমানলে-
মনঃকুণ্ডে অশ্রুধারা মনো দুঃখে ঝরি।"

মাইকেল মধুসূদন দত্ত বারবার ব্যর্থ হয়েছেন।ভাঙনের তোলপাড় তাঁকে ঝড়ের স্বরূপ দেখিয়েছে। মূলত 'চতুর্দশপদী কবিতাবলী'তে যে ধ্বনি শোনা যায়, তা কবির হৃদয়ের ভাষা। নিভৃতলোকের আন্তরিক কন্ঠস্বর। কবি হৃদয়ের রক্তক্ষরণের শব্দ আমাদের  অন্তর স্পর্শ করে।বেদনায় ম্লান হয়ে যায় বোধের আকাশ।   সার্বিক দিক থেকেই মধুসূদন দত্তের সনেটগুচ্ছ বাংলা সাহিত্যে হিরণ্ময় বৈভব।  হৃদয়ের  মায়াবি অরুণিমায় দীপ্র। সনেটসম্ভার কবির শিল্প ব্যক্তিত্বের সোনার কাঠির ছোঁয়ায় হয়েছে হৃদয়নন্দন।  অপরিমাণ চিত্তরঞ্জী।তাঁর  প্রতিভা ছিল তীক্ষ্ণধার। শব্দালংকার ও অর্থালংকারের মনোগ্রাহী   দ্যোতনায় অন্যান্য সৃষ্টির মত তাঁর 'চতুর্দশপদী কবিতাবলী'ও    আপন স্বকীয়তায় ভাস্বর।নিবিড় মনস্বিতা তথা প্রজ্ঞার  সোনার কাঠির ছোঁয়ায়  বিকশিত হয়েছে অনিন্দ্য সুন্দর সাহিত্য -শৈলী।  বাংলা ভাষা ও সাহিত্য উদ্ভাসিত হয়েছে হিরণ্ময় বর্ণ -বিভাসায় । 

সবশেষে আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি উক্তি চয়ন করব, "নবযুগের প্রাণবান সাহিত্যের স্পর্শে কল্পনাবৃত্তি যেই নব্য প্রভাতে উদবোধিত হল, অমনি মধুসূদনের  প্রতিভা তখনকার বাংলা ভাষার পায়ে চলা পথকে আধুনিক  কালের রথযাত্রার উপযোগী করে তোলাকে দুরাশা মনে করলেন না।...বাংলা ভাষাকে নির্ভীকভাবে এমন আধুনিকতায় দীক্ষা  দিলেন, যা তাঁর পূর্বানুবৃত্তি থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র... 
শাস্ত্রীক প্রথায় মঙ্গলাচরণের অপেক্ষা না রেখে কবিতাকে বহন করে নিয়ে এলেন এক মুহূর্তে ঝড়ের পীঠে _প্রাচীন সিংহদ্বারের আগল ভেঙে।"৫ 

তথ্যসূত্র 

১. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগ) অধ্যাপক মাহবুবুল আলম, খান ব্রাদার্স অ্যান্ড  কোম্পানি, ঢাকা ২০০৯, পৃ ৫৩১। 

২. সাহিত্য -সন্দর্শন, শ্রীশচন্দ্র দাশ,বর্ণ বিচিত্রা,  ঢাকা,২০২৩,পৃ: ৫৫  । 

৩. বাংলা সাহিত্যের সমগ্র ইতিহাস, ক্ষেত্রগুপ্ত, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন প্রথম প্রকাশ, ঢাকা, ২০০০, পৃ: ৩১৮।

৪. মধুসূদন কবিকৃতি ও কাব্যাদর্শ, সৈয়দ আলী আহসান, মুক্তধারা, ঢাকা, ২০১২, পৃ: ১৩০। 

৫. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন মধ্য ও আধুনিক যুগ), পূর্বোক্ত, পৃ: ৫৩২। 

লেখক :প্রফেসর জাহান আরা খাতুন 
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ
হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ 

নিউজটি আপডেট করেছেন : Suprobhat Michigan

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ
আটলান্টিক সিটিতে টিম স্মলের সমর্থনে সভা অনুষ্ঠিত 

আটলান্টিক সিটিতে টিম স্মলের সমর্থনে সভা অনুষ্ঠিত