আমেরিকা , শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫ , ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
বাংলাদেশে আবারও ভূমিকম্প গ্রোভস হাই স্কুলে সম্ভাব্য হুমকি, তদন্ত চলছে হ্যামট্রাম্যাক মেয়র নির্বাচন : ছয় ভোটের লড়াই, পুনর্গণনা চান মাহমুদ ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল দেশ : পুরান ঢাকায় ভবন ধসে তিনজনের মৃত্যু ডিয়ারবর্নে বিক্ষোভ : তিনজন গ্রেপ্তার, পুলিশের শান্ত প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ডিয়ারবর্নে এফবিআই অভিযানে দুইজন আটক হ্যামট্রাম্যাকের নতুন মেয়র আলহারাবী সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বাড়িতে বিএনপি নেতা-কর্মীদের হামলা পন্টিয়াকে অ্যামাজনের ড্রোন ডেলিভারি চালু কমার্স টাউনশিপে রেস্তোরাঁর বাইরে গুলিতে নিহত ম্যানেজার; সন্দেহভাজন গ্রেপ্তার মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড লক্ষ্মীপুরে বিএনপির সাধারণ সম্পাদককে কুপিয়ে হত্যা  হ্যামট্রাম্যাক নির্বাচন : বিতর্কিত ব্যালটের ভাগ্য সিল : ফল ঘোষণার অপেক্ষা ডিয়ারবর্ন হাইটসের মসজিদে হুমকি : ইলিনয়ের এক ব্যক্তি গ্রেপ্তার ৮ দল চাইছে আলাদা গণভোট, তিন উপদেষ্টার অপসারণ মিশিগান মেডিসিনের নতুন কান প্যাভিলিয়ন : বছরের শেষে রোগী সেবা শুরু হ্যালোইন সন্ত্রাস মামলায় ডিয়ারবর্নের তিনজন অভিযুক্ত হ্যামট্রাম্যাকের মেয়র নির্বাচন : বিতর্কিত ৩৭ ব্যালটের কারণে ফলাফল অনিশ্চয়তায় ড. ইউনূসের ঘোষণায় বিএনপি খুশি

মানবতার নীরব যোদ্ধা : বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষের পাশে তেৎসুও সুৎসুই

  • আপলোড সময় : ২২-১১-২০২৫ ০১:৪৭:২৭ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ২২-১১-২০২৫ ০১:৪৭:২৭ পূর্বাহ্ন
মানবতার নীরব যোদ্ধা : বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষের পাশে তেৎসুও সুৎসুই
গল্পটা শুরু করা যায় জাপান ও বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতির তুলনা দিয়ে। জাপান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কৃষিপণ্য আমদানিকারক দেশ। যার মোট ভূমির মাত্র ২০ শতাংশ কৃষিকাজের উপযোগী। কিন্তু এই সীমিত জমিকেও তারা আধুনিক প্রযুক্তি, সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও উচ্চমাত্রার দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সর্বোচ্চ উৎপাদনশীল করে তুলেছে। জাপানের সাথে বাংলাদেশের অনেক বিষয়ে মিল আছে।
জাপানিরা ভাত-মাছ খায়। জাপানে মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪ ভাগ ও আমাদের ৪০ ভাগ কৃষি কাজের সাথে জড়িত। জাপানের জিডিপিতে কৃষির অবদান মাত্র ২ শতাংশ; আর বাংলাদেশে এটি ১৩.৬৫ শতাংশ। বাংলাদেশে মোট জমির প্রায় ৫৮ শতাংশ এবং জাপানে মাত্র ১৩ শতাংশ চাষযোগ্য। দেশটির আবহাওয়া কৃষি উপযোগী। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয় এবং মাটিও উর্বর। অনুকূল আবহাওয়া, জমির উৎপাদক শক্তি এবং সর্বাধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে স্বল্প জমি থেকে অধিক উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে জাপান। কৃষিতে বাংলাদেশের ও সফলতাও কম নয়; স্বাধীনতার ৪৯ বছরে বাংলাদেশে কৃষিতে ঘটেছে এক নীরব বিপ্লব। বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিশ্বে ফসলের জাত উদ্ভাবনে প্রথম, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, চাল উৎপাদনে চতুর্থ, আম উৎপাদনে সপ্তম, আলু উৎপাদনে অষ্টম এবং খাদ্যশস্য উৎপাদনে দশম। এ সফলতার পেছনে রয়েছে বর্তমান সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি, কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং কৃষির আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ।
বাংলাদেশের হাওরাঞ্চলের কৃষি অর্থনীতি ও হাওরবাসীর জীবনমান উন্নয়নের স্বপ্ন বুকে নিয়ে জাপান থেকে ছুটে এসেছিলেন এক নিবেদিতপ্রাণ গবেষক। দূর সমুদ্র পাড়ি দিয়ে, ভিন্ন ভাষা–সংস্কৃতির দেশে এসে তিনি ৩৮ বছর ধরে কাজ করছেন আমাদের হাওরাঞ্চলের প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে। যার কথা বলছি তিনি জাপানি কৃষি উন্নয়ন গবেষক তেৎসুও সুৎসুই।
তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৩। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করেছেন, জীবনের দৌড়ে নামার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি জীবনের দুই চাওয়া আনন্দের খোঁজ আর জীবিকার প্রয়োজন এক সুতোয় বেঁধে নিলেন মানুষের প্রতি মমতার আদর্শে। মনস্থ করলেন এমন কোনো দেশে যাবেন, যেখানে এখনো মানুষ অনাহারে দিন কাটায়, যেখানে চিকিৎসার অভাবে কাতরায় অসংখ্য পরিবার, যেখানে উন্নয়ন পৌঁছেনি মানুষের দোরগোড়ায়। অনেক খোঁজখবর, চিন্তাভাবনা আর আত্মবিশ্বাসের মিশেলে তিনি এক অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত নিলেন জাপান নয়, নিজের আরামের জগত নয়, তিনি যাবেন বাংলাদেশে। পৃথিবীর মানচিত্রে ছোট্ট একটি দেশ, কিন্তু মানুষের সংগ্রাম, বেঁচে থাকার লড়াই এবং কৃষিভিত্তিক সমাজের অপরিসীম সম্ভাবনাই তাঁর মনকে টেনে আনল এখানে।
সময়টা ১৯৮৫ সাল। তেৎসুও সুৎসুইয়ের জীবনে তখন খুলে গেল এক নতুন দিগন্ত জাইকার ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করার বিরল সুযোগ মিলেছিল তাঁর হাতে। এই সুযোগই যেন তাঁর বাংলাদেশ-যাত্রার প্রথম সোপান। এরপর ১৯৮৬ সালে মৎস্য চাষ সম্প্রসারণ প্রকল্পে জুনিয়র এক্সপার্ট হিসেবে যোগ দেন জাইকার মাধ্যমে, কুমিল্লার বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ‘বার্ড’-এ। আর সেখানেই শুরু হয় তাঁর গভীর, নিবেদিত এবং নিরবচ্ছিন্ন মাঠকাজের অধ্যায়।
টানা চার বছর দিন-রাত এক করে তিনি কাজ করেছেন শুধু একটি লক্ষ্য নিয়ে: গ্রামের মানুষকে স্বনির্ভর করতে হবে, মাছ চাষকে জনপ্রিয় করতে হবে, এবং কৃষক-হাওরবাসীর জীবনমান উন্নয়নে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করতে হবে। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টা খুব দ্রুত ফল দিতে শুরু করে। কুমিল্লার আশপাশের জেলা ও উপজেলার গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে কমিউনিটি-ভিত্তিক মৎস্যচাষ। মানুষের আগ্রহ বাড়ে, পুকুর ও জলাশয়গুলোতে নতুনভাবে শুরু হয় মাছের চাষ। স্থানীয় পর্যায়ে এই উদ্যোগ এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে এলাকাজুড়ে যেন এক নীরব পরিবর্তনের ঢেউ তৈরি হয়।
কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ চিরকাল থাকে না। ১৯৮৯ সালে দায়িত্ব শেষ হলে তাঁকে ফিরে যেতে হয় জাপানে। শারীরিকভাবে তিনি দেশে ফিরলেন, কিন্তু মন পড়ে রইল বাংলাদেশেই। এখানকার মাটি, এখানকার মানুষের সরলতা, দুঃখ-কষ্ট, সংগ্রাম ও হাসিমাখা মুখ সবকিছুই তাঁর হৃদয় জয় করে নিয়েছিল। জাপানে ফিরে গিয়েও তাই তাঁর চিন্তায় ঘুরপাক খেত একটাই প্রশ্ন কীভাবে আবার ফিরে আসা যায় বাংলাদেশে?
ঠিক চার বছর পর, ১৯৯৪ সালে তেৎসুও সুৎসুই আবার খুঁজে পেলেন বাংলাদেশে ফেরার নতুন পথ। শাপলা নীড় নামে একটি জাপানী আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার ফান্ড রাইজিং কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। এই পদে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়েই তাঁর দ্বিতীয় দফা বাংলাদেশ অধ্যায়ের সূচনা। দুই বছর এই পদে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে তেৎসুও সুৎসুই প্রমাণ করলেন তাঁর দক্ষতা ও নিষ্ঠা কতখানি গভীর। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের শাপলা নীড়–এর তহবিল সংগ্রহ, মাঠপর্যায়ের সহযোগিতা এবং উন্নয়ন কার্যক্রম উল্লেখযোগ্যভাবে সম্প্রসারিত হলো। এরপর ১৯৯৬ সালে শাপলা নীড় এর টোকিও সচিবালয়ের ফেয়ার ট্রেড ডিভিশনের প্রধান হিসেবে যোগদান করেন। 
কিন্তু বাংলাদেশ তাঁর হৃদয় থেকে কখনোই দূরে সরে যায়নি। তাই টোকিওতে দায়িত্বপালনের মাত্র দুই বছর পর, ১৯৯৮ সালে, শাপলা নীড়-এর আবাসিক প্রতিনিধি হিসেবে আবার ফিরে এলেন বাংলাদেশে। এবার আরও বৃহত্তর দায়িত্ব নিয়ে, আরও গভীর পরিকল্পনা নিয়ে।
বাংলাদেশে শাপলা নীড়-এর আবাসিক প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেই তেৎসুও সুৎসুই শুরু করেন তাঁর নতুন মিশন। পর্যায়ক্রমে তিনি শাপলা নীড় এর কার্যক্রম নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ইত্যাদি জেলায় সম্প্রসারণ করেন। প্রতিটি জায়গায় তিনি মাঠপর্যায়ের মানুষের সঙ্গে সরাসরি কাজ করেন তাদের জীবনযাত্রা বোঝেন, তাদের সম্ভাবনা দেখেন, এবং সবচেয়ে বড় কথা, তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলেন। তার মূল দর্শন ছিল স্পষ্ট ও দৃঢ় মানুষকে আত্মনির্ভরশীলতার পথে দাঁড় করানো।
সাহায্যের জন্য চেয়ে থাকা নয়; বরং নিজের সামর্থ্য, নিজস্ব সম্পদ ও উদ্ভাবনী শক্তি ব্যবহার করেই যেন অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্ভব হয়। অথচ তখনকার বাংলাদেশে বিদেশি সাহায্যের স্রোত ছিল প্রবল। অসংখ্য প্রকল্প, দাতা দেশের অনুদান ও এনজিও কার্যক্রমের ভিড়ে অনেকেই বাহ্যিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিল। ঠিক সেই সময়ে সুৎসুই হেঁটেছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে। তিনি বিশ্বাস করতেন, অতিরিক্ত সাহায্য মানুষকে দীর্ঘমেয়াদে পরনির্ভরশীল করে তোলে, তাদের অভ্যন্তরীণ শক্তি ও সম্ভাবনাকে দুর্বল করে দেয়। তাই তাঁর উন্নয়ন মডেল ছিল কম সাহায্য, বেশি সক্ষমতা। এই আদর্শকে বুকে ধারণ করে তিনি এগিয়ে যেতে থাকেন দৃঢ় পদক্ষেপে। তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০২ সালে শাপলা নীড়-এর উপ-মহাসচিব হিসেবে পদোন্নতি পান। নতুন দায়িত্বে যোগ দিতে তাঁকে আবার জাপানে ফিরে যেতে হয়। শারিরীকভাবে তিনি জাপানে গেলেও মন পড়ে থাকতো বাংলাদেশে। এখানকার মানুষ, নদী, গ্রাম, হাওর, কৃষক সবই যেন তাঁর জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের মূল চরিত্র হয়ে উঠেছিল।
২০০৮ সালে তেৎসুও সুৎসুই শাপলা নীড়-এর মহাসচিব হিসেবে পদোন্নতি পান। দায়িত্বে তাঁর সততা, কর্মদক্ষতা ও মানবকল্যাণমূলক দর্শন তাঁকে এই শীর্ষ পদে আরও সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। তিনি ২০১৪ সাল পর্যন্ত এই পদে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছেন। একই বছর শাপলা নীড় থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নিলেও তাঁর উন্নয়ন-চিন্তা, মানবসেবা ও কৃষি-গবেষণার পথচলা থেমে থাকেনি। অবসরের পরই তিনি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গড়ে তোলেন আরেকটি উন্নয়ন সহায়তা সংস্থা‘শেয়ার দ্য প্লানেট এসোসিয়েশন’। মানুষের জীবনমান উন্নয়নের ব্যাপারে তাঁর বিশ্বাস, অভিজ্ঞতা এবং দীর্ঘ মাঠপর্যায়ের কাজের সারসত্তা যেন এই নতুন প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।
হবিগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চল যেখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর সংগ্রামের গল্প পাশাপাশি হাঁটে ঠিক সেই অঞ্চলেই জাইকার সহায়তায় তাঁর প্রতিষ্ঠান শেয়ার দ্য প্লানেট এসোসিয়েশন, স্থানীয় এনজিও এসেড এর মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। হাওরাঞ্চলের কৃষির সম্ভাবনা, জলাভূমি-নির্ভর অর্থনীতি, মানুষের জীবনযুদ্ধ এসবের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও উন্নয়ন চিন্তার জন্য এবার তিনি এগিয়ে এসেছেন গবেষণার কাজে।
এই প্রয়াসেরই অংশ হিসেবে হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার বাঘজোর গ্রামে নির্মাণ হচ্ছে‘সুৎসুই সান হাওর রিসার্চ অ্যান্ড রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট সেন্টার’। জাপানি ভাষায় যার নাম: ‘মিরানি নো দিইচি’। এই গবেষণা কেন্দ্রের নামকরণ করা হয়েছে তেৎসুও সুৎসুইয়ের নিজের নামে এ যেন বাংলাদেশের প্রতি, বিশেষ করে হাওরাঞ্চলের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা ও অঙ্গীকারের চিহ্ন। এটি কেবল একটি প্রতিষ্ঠান নয়; প্রায় চার দশকের নিবেদন, বিশ্বাস এবং ক্ষেত্র-গবেষণার অবিচ্ছেদ্য স্মারক। সুৎসুই যেন প্রমাণ করেছেন বাংলাদেশ তাঁর কাছে কর্মক্ষেত্র নয়; এটি তাঁর হৃদয়ের দেশ।
প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন- ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক কারণে হাওর অঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ। দেশের মোট আয়তনের প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ হাওর অঞ্চল। অঞ্চলটি সাতটি জেলার ৫৩ উপজেলাকে যুক্ত করেছে। হাওর কেবল প্রাকৃতিকভাবে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত এলাকা নয়, বরং খাদ্য নিরাপত্তা, প্রাণিসম্পদ ও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এ ছাড়া দেশের মোট গবাদি পশুর প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ এ অঞ্চলে পালন করা হয়। এখানকার প্রাকৃতিক চারণভূমি (বাথান) ও পানির সহজলভ্যতা গবাদি পশুর প্রজনন বৃদ্ধিতে সহায়ক। গবাদি পশু দুধ, মাংস, চামড়া ও সার উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। দেশের মোট হাঁসের প্রায় ২২ শতাংশ এ অঞ্চল সরবরাহ করে। কৃষিক্ষেত্রেও হাওরের ভূমিকা অনস্বীকার্য। দেশের মোট বোরো ধানের ৬০ শতাংশ হাওর থেকে আসে। পাশাপাশি নদী, খাল, বিল এবং জলাশয় মৎস্য উৎপাদনের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত। কিন্তু কৃষিজমিতে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক প্রয়োগের কারণে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর জন্য প্রাণঘাতী পরিবেশ তৈরি করে। ফলে শৈবাল বৃদ্ধির কারণে পানির নিচে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়, যা মাছসহ জলজ জীবনের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়। হাওরের মাটি অত্যন্ত উর্বর, যা ধান ও অন্যান্য ফসল উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমরা দেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী করতে পারি। হাওর অঞ্চলের বিপুলসংখ্যক মানুষ কৃষি, মৎস্য ও গবাদি পশু লালন-পালনে সরাসরি জড়িত। তাদের মাধ্যমে আমরা খাদ্য নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে পারি। খাল, বিল ও নদীর সুরক্ষা করে মাছ উৎপাদন আরও বাড়ানো যেতে পারে। হাওরের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রয়েছে ঘাস ও চারণভূমি, যা গবাদি পশু পালনে খরচ কমিয়ে আনে।
যাহোক বালাদেশ প্রেমি জাপানি গবেষক তেৎসুও সুৎসুই আরো বৃহৎ পরিসর নিয়ে বাংলাদেশের দু’টি অঞ্চলকে টার্গেট করে উন্নয়ন সহায়তা কার্যক্রম শুরু করেন। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, যশোর ও সাতক্ষীরা জেলা, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলার হাওরাঞ্চলকে নিয়ে জলাবায়ু পরিবর্তন ও দূর্যোগ সহনশীল কৃষি প্রযুক্তির প্রসার ও চাষাবাদ ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে তিনি ব্যাপক কার্যক্রম শুরু করেন। তাঁর সকল কার্যক্রম স্থানীয় পর্যায়ের এনজিওদের সম্পৃক্ত করে মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন চলতে থাকে। তিনি বাংলাদেশে ‘সিসিএএএন’ নামে একটি নেটওয়ার্কও তৈরী করেন। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টটিউট (বারি), আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি), হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, টয়োটা ফাউন্ডেশন, জাপানী কৃষি ও জলবায়ু উন্নয়ন বিষয়ক কয়েকটি সরকারী সংস্থা এবং বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কৃষি নিয়ে কাজ করে এমন ১৪টি এনজিও-কে এক সুতার গেঁথে উন্নয়ন কৌশল, তথ্য ও সম্পদ ভাগাভাগির মাধ্যমে সীমিত সম্পদকে অধিকতর মানুষের কল্যাণে ব্যবহারের জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বর্তমানে যেখানে বৈশ্বিক আর্থিক সংকটে নিপতিত উন্নত দেশসমূহ তাদের উন্নয়ন সহায়তা আমাদের দেশ থেকে কমিয়ে দিচ্ছে সেখানে নিবেদিতপ্রাণ এই মানুষটি বিভিন্ন সহায়তার উৎস তালাশ করে সেখান থেকে সম্পদ সংগ্রহ করে বাংলাদেশে অন্ত:ত ১৪টি উন্নয়ন উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছেন। এই উদ্যোগগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট হচ্ছে সহায়তার প্রায় ৮০% সম্পদ বিশেষ কৌশলসহ সরাসরি সুবিধাভোগীর হাতে পৌঁছে যায়। যার ব্যবহারের ফলে ৪-৫ বছরের মধ্যে সুবিধাভোগীরা আত্ম নির্ভরশীলতার পথে অগ্রসর হয়। উন্নয়ন সহায়তার পাশাপাশি এই মানুষটি খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে জাপানের কায়েটসু ইউনিভার্সিটি, এশিয়া ইউনিভার্সিটি, টোকিও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও উটসুনোমিয়া ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন।
বর্হিবিশ্বে মানবতার কল্যাণে কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি জাপানের আশাহি সোস্যাল ওয়েলফেয়ার এ্যাওয়ার্ড, ওকিনাওয়া পিস প্রাইজ, হিরোসিমা পিস প্রাইজ, এ্যাক্সেলেন্ট এনপিও  এ্যাওয়ার্ড ও জাপান র্পার্টনারশীপ প্রাইজ উইনার এ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। অথচ বর্হিবিশ্বের মধ্যে কাজের মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশই তার বাংলাদেশের মানুষের জন্য নিবেদিত। প্রশ্ন হচ্ছে এই নিবেদিত প্রাণ পরদেশি মানুষটিকে বাংলাদেশ কিভাবে মূল্যায়ন করবে- সেই ভাবনা কি সরকারের কৃষি বিভাগের আছে?
সবশেষে বলবো, জাপানে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে অল্প সময়ে কৃষক একাই অনেক বেশি পরিমাণ জমি চাষাবাদ করতে পারেন। জমি চাষ, চারা তৈরি, চারা রোপণ, ফসল কাটা, মাড়াই এবং বাজারজাতকরণের উপযোগী করা- সব কিছুই কৃষক যন্ত্রের সাহায্যে করতে পারেন। এটাই হলো আধুনিক জাপানি কৃষির বৈশিষ্ট্য। জাপানে হেক্টর প্রতি চালের উৎপাদনও আমাদের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি। আমাদের দেশে হেক্টর প্রতি চালের গড় উৎপাদন ২ দশমিক ২০ টন, জাপানে হেক্টর প্রতি চালের উৎপাদন ৬ দশমিক ৫৪ টন। এ ছাড়া জাপানে ভার্টিক্যাল ফার্মিং পদ্ধতিও ইদানিং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ পদ্ধতিতে গ্রিনহাউজে একের পর এক তাকে ফসল ফলানো হয়। কিয়াটো ও টোকিও অঞ্চলে এ ধরনের চাষ পদ্ধতির দেখা যায় বেশি। কৃষি ও কৃষি প্রযুক্তি উন্নয়নে বিনিয়োগের দুয়ার খুলে দিয়ে দেশটির কৃষিকে করে তোলা হয়েছে আধুনিক থেকে আধুনিকতর, বাণিজ্যিক ও স্মার্ট। অন্যান্য শিল্পের ব্যাপক অগ্রগতির কারণে জাপানের অর্থনীতিতে কৃষি এখন অত্যন্ত গৌণ খাত। তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশের জন্য অত্যন্ত শিক্ষণীয় একটি জায়গা হতে পারে জাপানের সম্ভাবনাময় আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর কৃষি খাত। বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে বাংলাদেশ প্রেমী কৃষি গবেষক তেৎসুও সুৎসুই-এর অনবদ্য ভুমিকার রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের দাবি রাখে।

লেখক : সাংবাদিক, অর্থনীতি বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক

নিউজটি আপডেট করেছেন : Suprobhat Michigan

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ
মানবতার নীরব যোদ্ধা : বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষের পাশে তেৎসুও সুৎসুই

মানবতার নীরব যোদ্ধা : বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষের পাশে তেৎসুও সুৎসুই