বৃহস্পতিবার, মে ২, ২০২৪

জনশ্রুতির আলোকে শ্রীমঙ্গল নামকরণের ইতিকথা

  • রজত শুভ্র চক্রবর্তী :
image

শ্রীমঙ্গল, (মৌলভীবাজার) ২০ জুলাই ॥  সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার সাতটি উপজেলার মধ্যে শ্রীমঙ্গল উপজেলায় বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠির সহাবস্থান এবং ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হিসেবে অনন্য বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। বিশেষ করে ঢেউ খেলানো
চা-বাগানগুলোর মনোরম দৃশ্যের জন্য বাংলাদেশের চায়ের রাজধানী খ্যাত শ্রীমঙ্গলের নাম দেশে বিদেশে আজ সমাদৃত। কিন্তু আমাদের গর্ব এই শ্রীমঙ্গল নামটি কিভাবে উৎপত্তি হলো তা নিয়ে দু’টি মতবাদ থাকলেও বহুল জনশ্রুত ও অধিক বিশ্বাসযোগ্য মতটি এখানে প্রকাশিত হলো।
শ্রীমঙ্গল উপজেলার অন্যতম প্রাচীন পরিবারের উত্তর প্রজন্ম এই এলাকার বাসিন্দা শ্রীমঙ্গল ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ফণী ভূষণ চক্রবর্ত্তী’র কাছে শ্রীমঙ্গল নামের উৎপত্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বৃটিশ কোম্পানি শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশের তৎকালীন স্বাধীন রাজ্য ত্রিপুরা’র রাজ কাছারী খোলা হয় এই অঞ্চলে। তখন ভাওয়াল-এর রাজকর্মচারী হিসেবে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করছিলেন উড়িষ্যা থেকে আসা আকুতরাম রামশরন দাশমুন্সী। ত্রিপুরার মহারাজার অনুরোধে তিনি তখন শ্রীমঙ্গলের এই অঞ্চলে কাছারী পরিচালনার জন্য তার দুই দৌহিত্র শ্রীদাশ মুন্সী ও মঙ্গলদাশ মুন্সী’কে পাঠান তৎকালীন সময়ের বালিশিরা পরগণার পূর্ব শ্রীমঙ্গল ও পশ্চিম শ্রীমঙ্গল মৌজা তথা এই এলাকার খাজনা আদায়ে মহারাজ কর্তৃক নির্মিত এই বাড়ীটিতে (শ্রীমঙ্গল উপজেলার পূর্বশ্রীমঙ্গল মৌজার সবুজবাগ এলাকায় অবস্থিত, যা বর্তমানে মুন্সী বাড়ী হিসেবে পরিচিত)। এই বাড়িটি তাদেরকে থাকার জন্য দান করেন ত্রিপুরার মহারাজা। এই বাড়ীতে থেকেই এ অঞ্চলের রাজখাজনা আদায় সহ কাছারি সংক্রান্ত অন্যান্য কার্যক্রম চালাতেন দুই ভাই। ত্রিপুরার মহারাজা কর্তৃক এ অঞ্চলে প্রদত্ত শ্রীদাশ মুন্সী ও মঙ্গল দাশ মুন্সীর আবাসস্থল হিসেবে পরবর্তীতে এ অঞ্চলের নাম রাখা হয় শ্রীমঙ্গল।


পরবর্তীতে কাছারি ঘরটি খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে বর্তমানে শ্রীমঙ্গল শহরের হবিগঞ্জ রোডের পাশে স্থানান্তরিত হয়। যা এখন শ্রীমঙ্গল উপজেলা ভুমি অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, এবং একটি ভবন প্রায় ধ্বংসের পথে। তৎকালীন সময়ে এখানে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠির আধিক্য ছিলো এবং কিছু সংখ্যক বাঙ্গালী জনেগোষ্ঠি ছিলো এর অধিবাসী।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত পাকিস্তান দেশ বিভাগের পর ধীরে ধীরে ওই বাড়ীর উত্তরাধিকারী কমতে থাকে । একসময় আর কোন বংশধর না থাকায় শ্রীদাশ মুন্সী ও মঙ্গলদাশ মুন্সীর উত্তর প্রজন্মের পারিবারের সদস্য সরোজিনী রায় ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে এই বাড়ীটি কুমিল্লা নিবাসী শম্ভু চরণ দেবনাথ নামের এক ব্যবসায়ীর নিকট বিক্রয় করে ভারতের কলকাতায় চলে যান।
উল্লেখ্য, ব্রিটিশ শাসনামলে মালামাল পরিবহনে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের স্থাপনা এই অঞ্চলে নির্মাণের প্রয়োজন হলে শ্রীমঙ্গল
রেলওয়ে স্টেশনটি স্থাপিত হয়। আর এই রেলওয়ে স্টেশনকে কেন্দ্র করে তৎকালীন রূপসপুর মৌঁজায় শ্রীমঙ্গল নামে একটি
স্মল টাউন গড়ে উঠে।
বৃটিশ কোম্পানি শাসনামলে বর্তমানে মতিগঞ্জ এলাকায় ছিলো শ্রীমঙ্গলের থানা কার্যালয়। পরবর্তীতে শ্রীমঙ্গল স্মল টাউন গড়ে উঠায় ধীরে ধীরে এই এলাকায় থানাসহ অন্যান্য প্রশাসনিক কার্যালয় স্থাপন করা শুরু হয়। শ্রীদাশ মুন্সী এবং মঙ্গলদাশ মুন্সী যে বাড়ীটিতে থাকতেন এবং রাজ কাছারি বা মুন্সেফি কার্যক্রম চালাতেন তাকে বলা হত মুন্সেফ বাড়ী যা কালক্রমে মুন্সীবাড়ী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এটির অবস্থান মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার পূর্বশ্রীমঙ্গল মৌজার সবুজবাগ এলাকায়। যেখানে একসময় উপাস্য দেবতার চারটি মন্দির ছিলো যা কালক্রমে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে বর্তমানে মহাকালের সাক্ষী হিসেবে একটি লক্ষ্মী মন্দির ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় রয়েছে।


পরবর্তী প্রজন্মের কাছে শ্রীমঙ্গলের নামকরণের সাথে জড়িত এই মুন্সীবাড়ীটির পরিচয় তোলে ধরার স্বার্থে ভগ্নপ্রায় মন্দিরটির দ্রুত সংস্কার, বাড়িতে প্রবেশের রাস্তাটি পাকাকরণ এবং শ্রীমঙ্গল নামকরণের উল্লেখযোগ্য ঘটনাসম্বলিত একটি ফলক এখানে স্থাপন করার দাবী এই বাড়ীতে বসবাসকারী শম্ভু চরণ দেবনাথের উত্তরপ্রজন্ম এবং স্থানীয় সচেতন জনসাধারণের। এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, শীগ্রই তিনি এই বাড়িটি এবং ভগ্নপ্রায় মন্দিরটি দেখে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেবেন।
এই ঐতিহাসিক বাড়িটিতে প্রবেশ পথের সংস্কারের ব্যাপারে কথা বললে শ্রীমঙ্গল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ভানু লাল রায় সরেজমিনে পরিদর্শন শেষে বলেন, তিনি অচিরেই রাস্তাটি সংস্কারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।


এ জাতীয় আরো খবর