রবিবার, মে ১৯, ২০২৪

বিজয়ার সিঁদুরে মাতল মিশিগানের রমনীরা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক :
image

ওয়ারেন, ০৬ অক্টোবর : দশমী বিহিত পুজা সমাপন ও দর্পন বিসর্জনে মিশিগানে শেষ হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। পাঁচ দিনের আনন্দ শেষে অশ্রুসজল নয়নে ভক্তরা বিদায় দেন মা দুর্গাকে। ‘বাবার বাড়ি বেড়ানো’  শেষে ‘ আনন্দময়ী’ দেবী ফিরে গেলেন ‘ কৈলাসের দেবালয়ে’। 


প্রবাসের জীবন কর্মময় ও রুটিন মাফিক। উৎসব প্রিয় জাতি বাঙ্গালি। এই কটা দিন সব হিসাব ওল্টা-পাল্টা করে মেতে ওঠেছিল পূজার আনন্দে। এই কটা দিনের বেহিসাবি জীবন থেকে পুনরায় রোজকার ছন্দে ফিরেছে সবাই।


গত ২৫ সেপ্টেম্বর দেবী দুর্গার আবাহন বা মহালয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় দেবী পক্ষের। আর মহাষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে ১ অক্টোবর শুরু হয় শারদীয় দুর্গাপূজা। এরপর একে একে ষষ্ঠী থেকে দশমী। সবগুলো তিথিতেই মিশিগানের পূজামণ্ডপগুলো ছিলো পূজারীদের বিনম্র প্রার্থণা আর নানান আনুষ্ঠানিকতায় পরিপূর্ণ। 


এদিকে গতকাল  বিকেল থেকেই ভক্তরা মিশিগান শিব মন্দির টেম্পল অব জয় ও ডেট্রয়েট দুর্গা টেম্পল বিজয়ার শান্তির জল ও প্রশস্তি বন্ধনের জন্য আসতে শুরু করেন। সন্ধ্যার পর মন্দির প্রাঙ্গন হয়ে ওঠে লোকে লোকারণ্য। সন্ধ্যায় শিব মন্দিরে দশমী বিহিত পূজা শেষে শুরু হয় আকর্ষনীয় আরতি ও ধুনচি নাচ। অন্তরা অন্তির কোরিওগ্রাফিতে এবং চিনু মৃধা ও সঙ্গীতা পালের পরিচালনায় ঢাকের বাজনার সঙ্গে আকর্ষনীয় আরতি ও ধুনচি নাচ  সকলের নজর কাড়ে।


এই ধুনুচি নাচ আসলে দেবী দুর্গাকে উৎসর্গ করা হয়। পুরাণ অনুযায়ী, দেবী দুর্গা নিজে ধুনুচি নাচ নেচে ছিলেন নিজের মধ্যে শক্তির সঞ্চারের জন্য। দেবতারা যখন মা দুর্গাকে জাগিয়ে তুলেছিলেন, সেই সময় দেবী নিজের মধ্যে শক্তি বৃদ্ধি করতে এই ধুনুচি নাচ নেচে ছিলেন। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, সেই থেকেই চলছে এই পরম্পরা।   


আরতির পর  বিবাহিত নারীরা সিঁদুর, পান, ফল ও মিষ্টি নিয়ে ‘দুর্গা-মা’কে সিঁদুর ছোঁয়ানোর পর তারা একে অপরের সিঁথিতে সিঁদুর দেন। সিঁথিতে সিঁদুর মাখানোর পর আঙুলে লেগে থাকা বাকি সিঁদুর তারা একে অপরের মুখে মাখেন। 


এটি-ই হলো সিঁদুর খেলা। নারীরা তাদের ও পরিবারের কল্যাণে এ ধর্মীয় আচার পালন করেন প্রতি বছরের দুর্গোৎসবে। সিঁদুর খেলার প্রাথমিক ইতিহাস অজানা। তবে ধারণা করা হয়, সিঁদুর শুভক্ষণের এই আচার অনুষ্ঠান আনুমানিক ৪শ বছর আগে শুরু হয়েছিল।


বিজয়ার শান্তির জল ও প্রশস্তি বন্ধন আনুষ্ঠানিকতা শুরুর প্রাক্কালে মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট চিকিৎসক এবং স্বনামধন্য দার্শনিক ডা: দেবাশীষ মৃধা, তার সহধর্মিনী চিনু মৃধা, মন্দিরের কো অর্ডিনেটন রতন হাওলাদার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। এরপরই শুরু হয় বিজয়ার শান্তির জল ও প্রশস্তি বন্ধনের আনুষ্ঠানিকতা। মন্দিরের প্রধান  প্রিস্ট পুর্ণেন্দু চক্রবর্তী অপু সব রকমের বাধা বিঘ্ন থেকে রক্ষা করার মন্ত্র উচ্চারণ করেন। পরে তিনি  ভক্তদের মাথায়  ছিটিয়ে দেন শান্তির জল। 


এ সময় মুখে গায়ে রঙ্গ মাখা ভক্তরা কিছুক্ষণ পরপরই উচ্চকন্ঠে ধ্বনি তুলেন ‘বল দুর্গা মা কি জয় ’। সেই সঙ্গে সকলেই শেষবারের মতো প্রণাম করেছেন মাকে। শান্তির জল গ্রহণ ও প্রশস্তি বন্ধন শেষে নারী পুরুষ সকলেই একে অপরকে আলিঙ্গনও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। পরে আগত ভক্তবৃন্দকে বিজয়ার মিষ্টিমুখ করানো হয়েছে। বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময়ে প্রবাসী ঘরে ঘরেও উৎসব শেষে চিরন্তন মনখারাপের সুর।


সনাতন ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, মহালয়ার দিন কন্যারূপে ধরায় আসেন দুর্গা। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের দশমী তিথিতে তিনি কৈলাস পাড়ি দেন। এদিন বিসর্জনের মধ্য দিয়ে তাকে এক বছরের জন্য বিদায় জানানো হয়।  আর এই দিনটি বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। পুরাণে মহিষাসুর বধ সংক্রান্ত কাহিনীতে বলা হয়েছে, মহিষাসুরের সঙ্গে ৯দিন, ৯ রাত যুদ্ধ করার পরে ১০ম দিনে তার বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেন দেবী। আর এই দিনটি ছিল শুক্ল পক্ষের দশমী। 


বিজয়া দশমী সেই বিজয়কেই চিহ্নিত করে। শাস্ত্র মতে, সব অসুরের বিনাশ আর অনিয়ম-জঞ্জালকে সরাতে দেবী দুর্গা গজে চড়ে মর্তে আসেন, যার অর্থ শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা। অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে বুধবার ৫ অক্টোবর) নৌকায়  চড়ে মর্ত্য থেকে স্বর্গে ফিরে গেলেন দেবী। নৌকায় চড়ে মত্য ছাড়লে ভক্তের মনোবাসনা পূর্ণ হবে। পৃথিবী হয়ে ওঠে শস্য শ্যামলা। কিন্তু সেই সঙ্গে অতি বর্ষণ বা প্লাবনের আশঙ্কাও রয়েছে। 


এদিকে গতকাল ৫ অক্টোবর বুধবার ছিল ওয়ার্কিং ডে। ওয়ার্কিং ডে এর কারণে মিশিগান কালীবাড়ীর শারদীয় দুর্গোৎসবের বিজয়া দশমী আগামী ০৯ অক্টোবর রোববার পালন করা হবে। এদিন সন্ধ্যায় বিজয়ার শান্তির জল ও প্রশস্তি বন্ধন দেয়া হবে।


অন্যদিকে ওয়ার্কিং ডে এর কারণে ডেট্রয়েট দুর্গা টেম্পলের অনেকের পক্ষেই বিজয়া দশমী ও শান্তি প্রশস্তি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ সম্ভব হয়নি। তাই ডেট্রয়েট দুর্গা টেম্পল কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী  অনুপস্থিত ভক্তবৃন্দ আগামী ০৯ অক্টোবর রবিবার সন্ধ্যায় বিজয়ার শান্তির জল ও প্রশস্তি বন্ধন গ্রহণ করতে পারবেন। 

উল্লেখ্য, পুজো উপলক্ষে শিব মন্দিরে ৯ দিনব্যাপী নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এসব আয়োজনের মধ্যে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, , কবিতা পাঠ ইত্যাদি। আগামী শনিবার ও রবিবার থাকছে ব্যতিক্রমী আরও কিছু আয়োজন।


এ জাতীয় আরো খবর