মঙ্গলবার, মে ৭, ২০২৪

বহু পরিশ্রমের ফল লবণ, জানুন আড়ালে থাকা নুন চাষীদের অজানা কথা

  • সুপ্রভাত মিশিগান ডেস্ক :
image

কলকাতা, ০৪ ডিসেম্বর : চাঁদের উল্টোপিঠ, যেটা নিয়ে মানুষের সাধারণত খুব একটা মাথাব্যথা থাকে না। আমরা যখন কোন জিনিস একেবারে তৈরি হাতের কাছে পেয়ে যাই তখন ক্ষণিকের জন্যেও ভেবে দেখি না যে এটা তৈরি কারা করেছেন কিংবা এটা তৈরি করতে তাদের কতটা পরিশ্রম হয়েছে। তাদের পরিশ্রম, তাদের স্ট্রাগল সবকিছুই আড়ালে থেকে যায়। আদৌ এই কাজে তাঁরা কতটা খুশি সেটা সম্পর্কে আমরা জানতেই পারি না। ঠিক এই ভাবেই বছরের পর বছর নিজেদেরকে আড়ালে রেখে ভারতে উৎপাদিত লবণের প্রায় ৭০ শতাংশ তৈরি করে চলেছেন গুজরাটের বহু মানুষ।

চীন এবং ইউনাইটেড স্টেটের পর ভারত হল তৃতীয় বৃহত্তম লবণ উৎপাদনকারী দেশ। কিন্তু এই দেশের লবণ চাষীরা এই চাষ করায় যতটা না লাভ পেয়েছেন তার থেকে অনেক বেশি নিজেদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করেছেন। বিবিসি নিউজের একটি প্রতিবেদনে গুজরাটের এই লবণ চাষীদের জীবনের কথা উঠে এসেছে। নারসি ভাই যিনি গুজরাটের একজন লবণ চাষী তিনি জানান, ছোটবেলা থেকেই লবণ চাষ করতে দেখে এসেছেন পরিবারের সদস্যদের । সেই মতো সময়ের সাথে সাথে তিনিও এই চাষে নিয়োজিত হন। বছরের পর বছর লবণ চাষ করতে গিয়ে তাদের পা ফুলে মোটা হয়ে যায়।
পরিস্থিতি এমন তৈরি হয় যে তাদের মৃত্যুর পর দেহ পর্যন্ত দাহ করা যায় না। কারণ আগুন সেই ভাবে পোড়াতে পারে না তাদের লবণ জল শুষে নেওয়া মোটা ফুলে যাওয়া পা গুলিকে। তাই বাধ্য হয়ে মৃতদেহকে গর্ত করে মাটিতে ফেলে লবণ দিয়ে চাপা দিয়ে দেওয়া হয়। তাদের জীবিকা মৃত্যুর পরেও রীতিমতো কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। সুরজ দেবী যিনি একজন লবণ চাষী তিনি জানান , বংশ পরম্পরায় এইভাবেই লবণ চাষ করে আসছেন তাঁরা। এটা দিয়েই তাদের সংসার চলে, দুবেলা দুমুঠো খাবারের যোগান হয় লবণ চাষ দিয়েই। তাই শরীরকে ভীষণভাবে ক্ষতি করলেও এই কাজ ছাড়ার উপায় নেই।
বর্তমানে প্রায় পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি মানুষ গুজরাটে লবণ চাষের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। এর থেকেও বেশি আশ্চর্য হবার মতো বিষয় হল তাঁরা প্রতি টন লবণ পিছু খুব জোর ৫০ টাকা আয় করেন। এই চাষ থেকে তাঁরা যা আয় করেন তা দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন চালানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তা স্বীকার করেন লবণ চাষীরা নিজেই। সরকারের তরফ থেকে তাদের জন্য বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। যেহেতু লবণ চাষ করার জন্য তাদেরকে লবণের জমিতে নামতে হয় তাই সরকারের তরফ থেকে এক ধরনের বুট দেওয়া হয়। কিন্তু তা এক বছরও সঠিক মত চলে না।
লবণ চাষের সঙ্গে যুক্ত অনেকেরই দাবি, যদি সরকার তাদের জন্য বুট, মোজা এবং চশমা দেয় তবে তাদের চোখ এবং পা অন্তত এতটা ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে পারবে। যেখানে আয় একেবারে অল্প সেখানে উচ্চশিক্ষা তো দূর প্রাথমিক শিক্ষাটুকু পাওয়াও বড় ভাগ্যের ব্যাপার । যদিও লবণ চাষীরা তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই কাজের মধ্যে আনতে আগ্রহী নন । তাঁরা চান অন্যান্য ছেলেমেয়েদের মত তাদের সন্তানরাও পড়ালেখা শিখে প্রতিষ্ঠিত হোক জীবনে । অন্তত লবণ চাষের উপর নির্ভর করে জীবন অতিবাহিত করতে হবে না তাদের।

এই লবণ কী ভাবে উৎপাদন করা হয় জানেন ?
বছরে মাত্র ছয় মাস লবন চাষ করা হয় । সমতল ভূমিতে মাটির ছোট ছোট আইল করে প্লট তৈরি করা হয়। সেই প্লট গুলি যখন কড়া রোদে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় তখন তার উপরে বিছিয়ে দেওয়া হয় বড় বড় পলিথিন। এরপর নদী থেকে লবণাক্ত জল ওই প্লটে এনে ফেলা হয়। চার থেকে পাঁচ দিন রোদে থাকার পর ওই লবণাক্ত জল ধীরে ধীরে শুকিয়ে যেতে থাকে । আর তৈরি হতে থাকে লবণের আস্তরণ। যখন লবণের আস্তরণ দেখা যায় তখন কোদালের মত এক ধরনের যন্ত্র দিয়ে হাতে টেনে টেনে লবণ গুলিকে নাড়াচাড়া করা হয়। এরপর লবণ ঝরঝরে হয়ে গেলে বড় বড় লবণ ব্যবসায়ীরা চাষীদের মাঠ থেকে সেই লবণ কিনে নিয়ে যান। রিফাইন করে বিক্রি করেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
লবণ ছাড়া রান্নাবান্নার কথা আমরা প্রায় ভাবতেই পারি না। কিন্তু কখনও এটা ভেবে দেখার অবসরই পাওয়া যায় না যে এই লবণ তৈরি হচ্ছে কী ভাবে? তৈরি করছেন কারা? যারা তৈরি করছেন তাদের জীবনযাপন ঠিক কী রকম ? এই লবণ উৎপাদন করতে গিয়ে কতটা শারীরিক এবং মানসিক সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের ? এইভাবেই বছরের পর বছর ধরে লবণ চাষীদের গল্পগুলো নোনা জলের আড়ালে চাপা পড়ে যায়।
সূত্র : ।। প্রথম কলকাতা ।।


এ জাতীয় আরো খবর