মঙ্গলবার, মে ৭, ২০২৪

বাংলার হিজল ফুল

  • চিনু মৃধা :
image

সাগিনা, ২৫ এপ্রিল : হিজলের ছন্দে, জীবনের রঙে...হিজল ফুল আমার প্রথম জীবনের সবচেয়ে ভালোলাগা ও মনে দোলা দেওয়া একটি ফুল। ‘হিজল বিছানো বন পথ দিয়া, রাঙায়ে চরণ আসিবে গো প্রিয়া।’ এক বন্ধুর প্রফাইলে হিজল ফুলের শেয়ার দেখে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার সুরে আমারও মন ছুটে গেলো ছোটবেলার সেই হিজল গাছের নিচে, লাল ফুলের গালিচার উপর ছোট ছোট পায়ে খেলা করার কত মধুর স্মৃতির দিনগুলিতে। 
হিজল ফুল অপুর্ব সুন্দর একটি ফুল। বৈশাখ জ্যেষ্ঠ মাসের দিকে হিজল ফুল ফোটে। ফুলের ঝুলন্ত মঞ্জুরি প্রায় ২ ফুট লম্বা হয়। গাছ ভর্তি হয়ে ফুলের মঞ্জুরি আসে। ফুলগুলো গোলাপী ও মিষ্টি লাল রঙের হয়। কোন কোন প্রজাতির ফুল সাদা হয়। হিজল ফুল সারা রাত ফোটে আর ভোরবেলা মিষ্টি রাঙ্গা হিজল ফুল গাছের নিচে ঝরে পড়ে সৃষ্টি করে এক দৃষ্টিনন্দন ফুল শয্যা। “পিছল পথে কুড়িয়ে পেলাম হিজল ফুলের মালা। কি করি এ মালা নিয়ে বল চিকন কালা” - হিজল ফুলের মনমাতানো গন্ধে পাগল হয়ে তাই আমাদের জাতীয় কবি আবার লিখলেন প্রেম ও বিরহের কবিতা। বাংলার সব কবিদেরই মনে হিজল ফুল দিয়েছে নাড়া, তাই তো জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন "এমনই হিজল-বট-তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ’। পল্লীকবি হিজলের সাথে বর্ষার সম্পর্ক এভাবে বলেছেন, হিজলের বন ফুলের আখরে লিখিয়া রঙিন চিঠি, নিরালা বাদলে ভাসায়ে দিয়াছে না জানি সেই কোন দিঠি! 


ছোটবেলায় আমরা ঘুম থেকে উঠেই দৌড়ে যেতাম হিজল তলায়। আমরা ফুলের মঞ্জুরি দিয়ে মালা বানাতাম , ফুলের কুড়ি দিয়ে খেলনা রান্নার ডাল বানাতাম, আর কাচা ফল দিয়ে জলের বুদবুদ ( Bubble)  বানাতাম। কাচা ফলে সাবানের মত এক ধরনের রস/কষ ছিল, সেটা জলের সাথে মেশালে বুদবুদ হয়। আমরা হাতে নিয়ে ফু দিয়ে উড়াতাম, পাঠকাঠি দিয়ে ফু দিয়ে বুদবুদ তুলতাম, দুর্বা ঘাস গোল করে তাই দিয়ে জলের বুদবুদ উড়াতাম। এটা ছিলো  আমাদের অতি প্রিয় একটি খেলা। আর হিজল ফুলের তুলতুলে আলতো স্পর্শ যেন এখনও পায়ে লেগে আছে।
হিজল ফলটি দেখতে হরীতকির মত হয়, প্রথমে সবুজ ও পরে বাদামী রঙ হয়। পাকা ফল অসম্ভব রকমের শক্ত ও তেতো হয়। দাদাদের দেখেছি পাকা ফলের বীজ দিয়ে গুল্টিস/ছিটকি খেলতে। 
হিজল একটি  দীর্ঘজীবী চিরহরিৎ গাছ। গাছ গুলো থোকা থোকা পাতায় ভরপুর। হিজল গাছ পুকুর, খাল, নদী-নালা ও জলাশয়ের ধারে বেশি জন্মায়। বাকল দেখতে ছাই রঙের, অমসৃন ও পুরু হয়। হিজল কষ্টসহিষ্ণু গাছ। জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে। বর্ষার দিনে গাছ গুলো গলা অব্দি জলে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। গ্রীষ্মের প্রচন্ড খড়াতেও ওরা ছায়া প্রদানকারী হয়ে মানুষের সেবায় আসে।  বন্যায় অনেক সময় হিজল গাছ সম্পুর্ন জলে ডুবে যায়, কিন্তু জল যাবার সাথে সাথেই আবার গাছটি জীবিত হয়ে উঠে। জলে নষ্ট হয় না বলে গ্রাম বাংলায় হিজল কাঠ নৌকা বানাতে খুব ব্যবহ্রত হয়। এই গাছটির উচ্চতা প্রায় ৩০ / ৪০ ফিট পর্যন্ত হয়। কিছু কিছু গাছ বট গাছের মত বড় আর ঝাঁকড়া হয়। এর পাতাগুলি ঘন, মসৃণ, থোকা থোকা ও পুরু, প্রায় ৩ - ৪ ইঞ্চি লম্বা এবং ২ - ৩ ইঞ্চি প্রস্ত হয়। 


অনেক এলাকায় এই গাছের কচি পাতা খাদ্য হিসাবে গ্রহন করে। ভিয়েতনামে, এই গাছের কচি পাতা দিয়ে মাংস বা চিংড়ি দিয়ে রান্না একটি জনপ্রিয় খাবার।
এই গাছের বাকল ও ফলে অনেক ঔষধী গুরুত্ব আছে।  অ্যান্টিটিউমার, অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিনোসিসেটিভ এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল সহ বেশ কয়েকটি রোগের চিকিৎসার ঔষধের জন্য ব্যবহার করা হয়।
এই হিজল গাছের আদিবাস অস্ট্রেলিয়ার উপকূলীয় জলাভূমিতে, কিন্তু  দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটান, আফগানিস্তান এও রয়েছে এর বিস্তার। এর সাধারণ নামগুলির মধ্যে Freshwater Mangrove এবং Mango-Pine খুব পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম Barringtonia Acutangula এবং এটি Barringtoniaceae পরিবারের একটি প্রজাতি।

চিনু মৃধা : লেখিকা ও সমাজ সেবিকা, সাগিনা, মিশিগান।


এ জাতীয় আরো খবর