মঙ্গলবার, মে ৭, ২০২৪

নজরুল ইসলাম : এক বিস্মৃতপ্রায় সাংবাদিকের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলী

  • হেলাল উদ্দিন রানা :
image

ওয়ারেন, ৫ নভেম্বর : নজরুল ইসলাম। সিলেট অঞ্চলের অত্যন্ত সাহসী এক সাংবাদিক। সময়ের পরিক্রমায় এই অকাল প্রয়াত সাংবাদিক প্রায়বিস্মৃত হতে চলেছেন আজ। অথচ সিলেটে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে নজরুলের অবদান কোন অংশে কম নয়। তিনি ছিলেন একজন বিবেকবোধ সম্পন্ন প্রজ্ঞাবান সাংবাদিক। গেলো শতাব্দির আশি ও নব্বইয়ের দশকে সিলেটের সাংবাদিকতায় তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য।পরোপকারী নিবেদিত প্রাণ নজরুল ছিলেন সমাজে সকলের কাছে প্রিয় ও গ্রহণযোগ্য মানুষ। বন্ধু বৎসল, নম্র-ভদ্র অমায়িক নজরুল সাংবাদিক সমাজেও ছিলেন সমাদৃত। সকলের আস্থাভাজন ও নির্ভরযোগ্য। তিনি যেমোন ছিলেন নির্ভীক তেমনি ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী। যে কোন জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ছিল তাঁর কলম ও কন্ঠ। মানুষের বিপদে আপদে নিঃস্বার্থ ভাবে ঝাপিয়ে পড়তেন একেবারে কোমর বেঁধে। অন্যের জন্য নিজের সংসার, কাজ পেছনে ফেলে ছুটে বেড়াতেন। ধর্না দিতেন নানা জায়গায়। আমরা যেখানে রিপোর্ট করেই দায়িত্ব শেষ মনে করতাম, সেখানে নজরুল সেই সমস্যার গভীরে যেতেন, সমাধান দেয়ার চেষ্টা করতেন। 
সারা জীবন সাংবাদিক নজরুল নিজের খেয়ে তাড়িয়েছেন বনের মোষ। প্রায়ই দৈনিক ইনকিলাবের অফিসে এসে চায়ের অনুরোধ  জানিয়ে আমাদের অফিস সহকারী সাইফুলকে বলতেন সাদা কাগজ নিয়ে আসতে। ধুমায়িত চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে মনোনিবেশ করতেন দরখাস্ত ,অভিযোগ লেখায়। নানা দফতরে এসব অভিযোগ অনুযোগ জমা পড়তো। সবটাই মানুষের জন্য। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজে সিনিয়র ফার্মাসিষ্ট হিসাবে সরকারী চাকরী ছিল।সামনে অনেক লোভনীয় অফার থাকলেও নজরুল এসব মাড়িয়েছেন দুপায়ে। তাঁর সহকর্মী কেউ কেউ শহরের নামি দামী ফার্মেসীতে কাজ করতেন সরকারী চাকরীর বাইরে। নজরুল অর্থের পেছনে না ছুটে তাঁর সময় ব্যয় করতেন জন কল্যাণে-সাংবাদিকতায়।
হাসপাতালের ওষুধের ডিসপেনসারি তাঁর দায়িত্বে ছিল। তিনি আমানতের হেরফের করেননি। আর্থ মানবতার সেবাই ছিল ব্রত।সাংবাদিকতা চলতো পাশাপাশি সখের বশে ।বেতন কি পেতেন জানিনা তবে লন্ডন থেকে বড় ভাইকে সব সময় অর্থনৈতিক ভাবে সহযোগিতা করতে দেখেছি। কোন কারণে লন্ডন থেকে অর্থ আসতে দেরী হলে ঋণ করতেন। আবার টাকা পেয়ে পরিশোধ করতেন। দু:স্থ অসহায় রোগীদের সাহায্য সহযোগিতা করেছেন অকাতরে। হাসপাতালে তাঁর সহকর্মীরা সকলেই তাঁকে সম্মান করতো, ভালবাসতো।
একবার এক ভদ্রলোক তাঁর যুবতী মেয়েকে সাথে করে ইংল্যান্ড থেকে সিলেটে বেড়াতে আসেন। এই ভদ্রলোকের সাথে দেশে অন্যদের জায়গা জমি নিয়ে বিরোধ, ঝামেলা ছিল। লন্ডনে ফিরে যাবার দিন প্রতিপক্ষ মিথ্যা মামলায় ভদ্রলোককে ওসমানী বিমানবন্দর থেকে পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করায়। এই আকস্মিক বিপদে ভদ্রলোক ভেঙে পড়েন। যুবতী মেয়েটি হয়ে পড়ে একদম অসহায়, একা। নিকট আত্মীয়ের অনুরোধে নজরুল ভাই সাথে সাথে এয়ারপোর্টে ছুটে যান। এদিকে তাঁর নিজের স্ত্রী হন্যে হয়ে তাঁকে খোঁজতে থাকেন শহরে।সম্ভাব্য সব জায়গায় ফোন দেন। তখন বেশ রাত হয়ে গেছে, সেই সকালে কাজে বেরিয়ে তিনি ফেরেননি। দুপুরে প্রতিদিন বাড়ীতে খেতে গেলেও সেদিন যাওয়া হয়নি সংগত কারণেই।
আমাকে ফোন দিয়ে জানতে চাইলে ভাবীকে আমি তাঁর কোন হদিসই দিতে পারলাম না। অবশেষে নজরুল ভাই নিজেই আমার অফিসে ফোন দিয়ে জানালেন তিনি কতোয়ালী থানায় আছেন। একটি জরুরি কাজে আটকা পড়েছেন। আমাকে অনুরোধ করলেন ভাবীকে যেনো ম্যানেজ করি। ফিরে এসে বিস্তারিত জানাবেন। প্রায় মধ্যরাতে এসে এব্যাপারে আমারও সাহায্য চাইলেন। সাথে করে বাড়ীতে নিয়ে গেলেন গিন্নীর রোষ থেকে রেহাই পেতে। পরের সারাদিন অনেক খাটাখাঁটি ও পরিশ্রম করে ভদ্রলোকের জামিনের ব্যাবস্থা করে তাকে মুক্ত করে আনলেন নিজের গাটের টাকায়। পরে বিমানের টিকেট রিকনফার্ম করে লন্ডনের ফ্লাইটে বাপ মেয়েকে বসিয়ে তবেই তিনি স্বস্তি পেলেন। এই ছিলেন সাংবাদিক নজরুল। তাঁর মন ছিল শিশুর মতো সারল্যে ভরা।
এখানে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে হয়। একদিন বিবির সাথে ঝগড়া করে গৃহত্যাগ করলেন নজরুল ভাই। ভাবী আমাকে ফোন দিলেন। শহরে অনেক খোঁজাখোঁজির পর খবর এলো বিকেলে। তিনি বউয়ের সাথে রাগ করে শ্বশুরবাড়ী চলে গেছেন। সেখানে জামাই আদরে আপ্যায়নের পর সুখ নিদ্রায় নিমগ্ন ।সেখানে গিয়েই শ্বাশুড়ীকে তাঁর আগমনের হেতু জানিয়ে হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে ফেলেছেন। এনিয়ে পরে অনেক হাসাহাসি হলো। নজরুল ভাইয়ের মোটর বাইকটি ছিল ব্র্যান্ডেড। আওয়াজ শুনলেই বোঝা যেতো তিনি আসছেন।
এই বাইকটি ছিল আমাদের অনেক না বলা ইতিহাসের সাক্ষী। নজরুল ভাই আমার জন্য ভাইয়ের চাইতে বেশী করেছেন। আমার মা দুরারোগ্য ক্যানসার ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে ডাক্তারের পরামর্শে তাঁকে অনেকদিন বাড়ীতে চিকিৎসা দিতে হয়। প্রতিদিন স্যালাইন ও ইনজেকশন পুশ করতে হতো। সেই কঠিন সময়ে তিনি সব সময় পাশে ছিলেন। নজরুল ভাই এই কাজটির দায়িত্ব নিজে নিলেন। তিনি রুটিন করে বিকেল পাঁচটার মধ্যে এসে হাজির হতেন প্রতিদিন। বহুদিন তিনি এই ডিউটি পালন করেছেন। এতে করে আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পেরেছি, ভরসা পেয়েছি। আমার মা তখন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডাঃ অধ্যাপক এমএ রবের তত্বাবধানে চিকিৎসাধীন। তাঁর রেডিও থেরাপি প্রয়োজন। থেরাপি দিতে হলে ঢাকায় নিতে হবে। সেইসময় সিলেটে একটি মেশিন থাকলেও অনেক দিন ধরে বিকল পড়ে আছে শুধু একটি বাল্ব অকেজো থাকার কারণে। এটি সচল করতে হলে প্রায় ৬০ লক্ষ টাকা ব্যয় করতে হয়। যার জন্য সরকার কোন উদ্যোগ নিচ্ছেনা। অথচ সারা দেশের মধ্যে সিলেটে সবচেয়ে বেশী ক্যান্সার রোগী। ভারতের সিলেটের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকেও এখানে চিকিৎসা নিতে অনেক রোগী আসে। বাল্বটি জার্মানীর বিখ্যাত সীম্যান্স কোম্পানীর তৈরী।
নজরুল ভাই বললেন নিউজ করেন। আমি ইনকিলাবে এনিয়ে একটি রিপোর্ট করলাম। তিনি নিজে জালালাবাদীতে নিউজ করলেন। পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ নানা স্থানে এসব পেপার কাটিং সংযুক্ত করে দরখাস্ত পাঠালেন। নানা জায়গায় চেষ্টা তদবিরে এতে কাজ হলো। তারা তৎপর হলো।য ন্ত্রাংশ নিয়ে সীম্যান্স প্রকৌশলী সিলেটে এলেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে মেশিনটি সচল হয়ে উঠলো।আমার আম্মার থেরাপি প্রদানের মাধ্যমে এটি পুনরায় চালু হলো। তখনকার পুরানো মেডিকেল ভবন চৌহাট্টায় ছিল ক্যান্সার বিভাগ।
এমনকি যখন আমার মার মৃত্যু হয় তখনও আমার আত্মার সুহৃদ নজরুল ভাই পাশে ছিলেন। আমার আম্মাও তাঁকে সন্তানের মতো স্নেহ করতেন। তিনি আমার সকল দুঃসময়ে ছায়ার মতো পাশে থেকেছেন, সাহস ও শক্তি যুগিয়েছেন। মনে পড়ছে প্রায় ত্রিশ বছর আগের কোন একদিন আমি দেশ ছেড়ে আসার সময় একেবারে বিমানের দরজা পর্যন্ত এসে বিদায় দিলেন। তাঁর সেই অশ্রু সজল চোখ জোড়া মনে পড়লে দুনয়ন ভরে উঠে জলে ! তাঁর শেষ আলিঙ্গন এখনও টের পাই, সেই স্পর্শ অনুভব করি বুকে !
সেলিনা আমার স্ত্রী, তাঁকে আপন বড় ভাইয়ের মতো জ্ঞান করতেন। তিনিও স্নেহ করতেন নিজের বোনের
মতো করে। শহরতলীতে আমাদের বসবাস ছিল কাছাকাছি।মাত্র মাইল খানেকের মতো দুরত্ব ছিল উভয়ের মধ্যে। আমরা ছিলাম একে অন্যের পরিবারের সদস্যের মতো। তিনি আব্দুল ওয়াহেদ খাঁন সম্পাদিত সিলেট সমাচার ও দৈনিক জালালাবাদীতে কাজ করেছেন। বহু আলোচিত ও সাহসী রিপোর্ট করেছেন জীবনে।১ ৯৯২ সালের মার্চে তুচ্ছ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিডিআর-এর সাথে জনতার যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে, যার জের ধরে দৈনিক জালালাবাদীতে আগুন দেয়া হয় পুড়ে যায় সম্পাদকের গাড়ী, সেই আলোচিত রিপোর্টটি করেছিলেন সাংবাদিক নজরুল ইসলাম। রিপোর্ট ছিল বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ। সেদিন আমরা একসাথে এই এসাইন্টমেন্টে আখালিতে বিডিআর হেডকোয়াটারে যাই। নজরুল ভাই মোটর সাইকেল চালাচ্ছিলেন আর আমি পেছনে ছিলাম। উত্তেজিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে বিডিআর হঠাৎ গুলিবর্ষণ শুরু করলে মানুষের হট্টগোল আর দৌড়াদৌড়িতে এক নারকীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়। আমরা তখন কোনমতে শহরে ফিরে আসতে বাধ্য হই। আমাদের কাছে সেদিন নিশ্চিত ভাবে কোন প্রাণহাণির তথ্য ছিলনা। কিন্তু আমাদের লিখতে হয়! সর্বদলীয় জনসভায় প্রাণহাণির দাবী করা হলে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা জনসভার বরাতে তা রিপোর্টে উল্লেখ করি।জালালাবাদী তাদের রিপোর্টে নিহতের কোন উল্লেখ না করায় রোষানলে পড়ে। নজরুল ভাই ক্রাইম বিট কাভার করতেন জালালাবাদীতে।সন্ধ্যায় প্রতিদিন কথা হতো আমাদের মধ্যে। তখন ইনকিলাব সিলেট ব্যুরো কেন্দ্রিক একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ছিল আমাদের। বৃহত্তর সিলেটে কোন ঘটনা ঘটলে সম্ভব দ্রুত সময়ের মধ্যে চলে আসতো হাতে। নজরুল ভাই টেবিলে বসে আয়েশী রিপোর্ট করার চাইতে ফিল্ডে ছুটে যেতে পছন্দ করতেন, উৎসাহী ছিলেন।
যে কোন সংবাদ, তথ্য উপাত্ত সংগ্রহে প্রচুর শ্রম ও ঘাম ঝরাতেন এই নিষ্ঠাবান সাংবাদিক। জীবনে বহু সাড়া জাগানো রিপোর্ট করেছেন।সিলেটের আলোচিত আফরোজ বক্ত হত্যাকাণ্ডের (যার প্রধান আসামী ছিলেন তৎকালীন এমপি গউস উদ্দিন) একজন পলাতক আসামির সাক্ষাৎকার নিতে তিনি গভীর রাতে আসামির কথামত একাকী একটি হাওরের নির্জন টিলায় উপস্থিত হন। যেখানে দিনে যেতেও লোকজন সাহস পেতনা। আমি যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসার পর তিনি দৈনিক ইনকিলাবের ব্যুরো চীফ হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন।
এই ক্ষণজন্মা সাংবাদিক হৃদরোগে আক্রান্ত হলে ঢাকা হৃদরোগ ইন্সিটিউটে তাঁর ওপেন হার্ট সার্জারি হয়। কিন্তু তাঁকে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি। সার্জারির পর নজরুল ভাই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে সিলেটে ফেরেন। পরে তাঁর রক্তে ইনফেকশন ধরা পড়ে জটিলতা দেখা দেয়। তাঁর পরিবারের অভিযোগ একটি ইনজেকশান পুশ করা হয় তাকে। আর ফিরে আসেননি তিনি। ২০০৩ সালের মার্চে পৃথিবীর মোহ মায়া কাটিয়ে পাড়ি দেন অসীমের পানে। তাঁর পরিবার মনে করে তাঁকে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করা হয়েছে ! এই বিষয়টি আল্লাহ ভালো জানেন।তিনি গায়েবের মালিক। তবে এমন অভিযোগ যদি সত্যি হয় এই ষড়যন্ত্রে যে বা যারা জড়িত তারা নিজেদের কর্মের শাস্তি একদিন ভোগ করবেই !
জীবন চলার পথে আমার নিজের পক্ষ থেকে অনেক ভুল ছিল, ত্রুটি- বিচ্যুতি ছিল জানি। কিন্তু এসবের জন্য কার কাছে মাফ চাইবো ? কাকে বলবো ক্ষমা করে দিন ? নজরুল ভাই আপনি আজ এসবের বহু উর্দ্ধে চলে গেছেন। আমার সকল অক্ষমতা ক্ষমা করে দিবেন।আপনি আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু এই হৃদয়ে আপনি আছেন, থাকবেন। এই অকুতোভয় মহৎ সাংবাদিকের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা হে দয়াময় তুমি আমাদেরকে ক্ষমা করে দাও। তাঁর পরিবারকে হেফাজত করো।হে প্রভু দয়া করে প্রিয় নজরুল ভাইকে জান্নাতুল ফেরদাউসে জায়গা করে দাও।
হেলাল উদ্দিন রানা, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক।


এ জাতীয় আরো খবর